Sunday, June 16, 2013

সাম্রাজ্যের মন, স্পিলবার্গের প্রাচ্য অথবা ইন্ডিয়ানা জোন্সের বিচার



দুনিয়ার সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ পাঁচজন কালজয়ী চলচ্চিত্রকারের নাম চেয়ে একবার দর্শকদের কাছে  ভোট আহ্বান করেছিল মার্কিনমুলুকের অন্যতম বাজারি পত্রিকা নিউইয়র্ক টাইমস। পাঠকদের পাঠানো প্রতিক্রিয়া বা ভোটের ভিত্তিতে স্টিভেন স্পিলবার্গের নাম ভেসে উঠে পয়লা নম্বরে। একজন পরিচালক হিসাবে চলচ্চিত্রের টেকনিক, ম্যাকানিজম ও টেকনোলজির ব্যবহারে তিনি অপূর্ব। তার তৈরী সিনেমার মধ্যে ‘ইন্ডিয়ানা জোন্সের চারটি সিক্যুয়াল [Raiders of the Lost ArkIndiana Jones and the Temple of DoomIndiana Jones and the Last CrusadeKingdom of the Crystal Skull]  ও জুরাসিক পার্কের সিক্যুয়ালসমূহ [Jurassic Park, The Lost World, Jurassic Park III, Jurassic Park 4 The Extinction]দেখেন নাই এরকম দর্শক পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ।

সিনেমার নিজস্ব ভাষা বা ক্যামেরা মুভমেন্টের ব্যবহারে তিনি এত দক্ষ যে, তার সিনেমা ইংরাজি ভাষা না জানলেও কারো ভাষাগত সমস্যা হয় না। শিশুর লাহান ইশারাভাষী দর্শকও তার ছবির দিকে বিষ্ময়ে তাকিয়ে থাকবে। একজন পরিচালক হিসাবে এটাই তার সফলতার মুল কারণ। তার সিনেমাগুলা একে একে পৃথিবীর সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ জনপ্রিয় ছবিতে জায়গা করে নিয়েছে ইতোমধ্যে পশ্চিমা মিডিয়াগুলার বাজারি পরিসংখ্যানে।

এক জবানদান অনুষ্ঠানে তিনি বলেছিলেন ‘আমি চলচ্চিত্রের ভাষায় ছবি বানাই’।
কথাটা হাস্যকর শোনালেও আলবৎ হাছা। যে পরিচালক চলচ্চিত্রের ভাষায় ছবি বানায় তার ছবিতে ভাষাগত সমস্যা হয় না। যেমন ডব্লিউ ডি  গ্রিফিথ, আইজেনস্টাইন, চ্যাপলিন, ডে সিকা, জা লুক গদার, ইলমাজ গুণে, ফাসবিন্ডার, পুদোভকিন, দভজেঙ্কো, হিচককদের ছবি দেখতে ভাষার সমস্যা হয়না  কোনো দর্শকের। এদের মধ্যেও সবশ্রেণির দর্শকদের কাছে স্পিলবার্গের গ্রহণযোগ্যতা বিষ্ময়কর। কারণ তার বিষয়-বৈচিত্র। সব ধরনের বিষয় নিয়াই তিনি কাজ করেছেন। জনপ্রিয় ধারার জিকজাক ছবি করার জন্য সিরিয়াস সমালোচকরা তাকে ‘মুভি জাগলার’ বা ‘মুভি ম্যাগনেট’ বলে গাল পাড়েন।  জনপ্রিয় ধারার ছবি যেমন তিনি তৈরি করেন তেমনি বর্ণবাদ নিয়ে তৈরি করেন ওয়াকার এলিসের ফিকশন অবলম্বনে ‘কালার পার্পল’র মত সিরিয়াস ধর্মী ছবি বা নাজিযুগ নিয়া বানান ‘শিল্ডলার্সলিস্ট, মিউনিখ’। 
তার প্রত্যেকটা ছবিতেই প্রায় সর্বোচ্চ ব্যবসা ও অ্যাকাডেমি পুরষ্কার ধরাবাঁধা। 

তার প্রথম যে সিনেমাটা ছোটবেলায় নিজের অজান্তে একঘণ্টা তিরিশ মিনিট আমাকে টেলিভিশনের পর্দায় আটকে  রেখেছিল তার নাম ‘জস’।
ছবি যে এত আকর্ষক ও আনন্দদায়ক হতে পারে এই প্রথম জানা। ‘জস’র পরের সিক্যুয়ালতো বটেই, স্পিলবার্গজির এমন কোনো ছবি নাই যা সংগ্রহ করি নাই বা দেখি নাই। শুধু একবার নয় বহু বহুবার করে একেকটা ছবি দেখা। দেখি কারণ তার সিনেমার শব্দ ব্যবহার, ডিটেলসের ব্যবহার, ক্যামেরা মুভমেন্ট, কালচেতনা, ইনার আই ও গতি অসামান্য।
সম্প্রতি আবার তার ‘ইন্ডিয়ানা জোন্স’র সিক্যুয়ালগুলো  দেখতে গিয়া চোখ আটকে গেল। বিশেষ করে ‘রেইডার্স অব দি লস্ট আর্ক,‘টেম্পল অব ধূম’ ছবি দুইটা দেখে মনে হল এগুলা নির্মাণগত মুগ্ধতা স্বত্বেও পূণবিবেচনা দাবি করে। 
রেইডার্স অব দি লস্ট আর্ক ছবিটা দেখার আগেই  বইটি পড়া ছিল। ক্যাম্পবেল ব্ল্যাকের দুর্দান্ত ত্রিলার। অনেকদিন আগে পড়া, কোন দোষ খোঁজে পাই নাই তখন। মন্ত্রমুগ্ধের মতো পড়েছি। পরে এই ছবির কোথাও লেখকের নাম না দেখে একটু বিষ্মিতও হয়েছি। হয়তো আমার চোখে পড়ে নাই এরকমও হতে পারে। 
বলাবাহুল্য স্পিলবার্গ খুব বাধ্য আমেরিকান। আমেরিকান বা হলিউডের আদর্শই তার আদর্শ। এবং আমেরিকার দেবত্ব ও হিংস্রতা, প্রাচ্যদখলনীতি, ঘৃণা, তুচ্ছতা ও আতঙ্কের চোখে প্রাচ্যকে দেখা ইত্যাদি গুণ তার মধ্যে পুরাপুরি জারি আছে। যার প্রমাণ লুকিয়ে আছে তার এই সিনেমায়।
রেইডার্স অব দি লস্ট আর্কে আমরা দেখতে পাই  নেপাল আর মিশরকে। ইন্ডিয়ানা জোন্স নেপালে বেশিক্ষণ থাকেন নাই। খুব স্বল্প সময়ের যে নেপালকে দেখানো হলো তা হচ্ছে রেস্তোরায়, বারের ভেতর ঝগড়ারত মামুলি জনগণ, গুপ্তধনের জন্য হত্যামুখি চায়নিজ-নেপালি যে কিনা লোভ করতে গিয়ে প্রায় আগুনেই পুড়তে বসেছিল তার পাপের প্রায়শ্চিত্য হিসাবে। প্রাচ্যবাসীর হাতে ভয়ংকর অস্ত্র  থাকা সত্বেও মাত্র একটা চাকুক নিয়ে ইন্ডি বধ করে ডজন দুয়েক চায়নিজ-নেপালিকে। 

তবে ছবির অর্ধেক জুড়ে মিশরকে দেখা যায়। আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদের আরব বা প্রাচ্য বিরোধিতার পুরাপুরি প্রমাণ পাওয়া যায় ছবির এই মিশর খণ্ডে। তিনি মিশরি আরবদের উপস্থিত করেন ভয়াবহভাবে। তারা লম্বা দাঁড়ি রাখে কারণ জাতে মুসলমান। ভয়ংকর জোব্বা পরে। জাত অপরাধী আর বগলে ছুরি নিয়ে ঘুরে। খাবারে বিষ মেশায়। বিদেশি নারী দেখলেই ধর্ষণ করতে চায়। বানরের মত একটা নীরিহ প্রাণিকে স্পাই হিসাবে ব্যবহার করে কাজ হাসিল করে। মিশরিরা খুব খারাপ তারা ক্রীতদাসদের নিয়ে মাটি খনন করায়। ক্রীতদাসদের বেত্রাঘাত করে। যেন আমেরিকানরা কোনদিন ক্রীতদাস দেখে নাই। ছবিটি  দেখতে দেখতে স্পিলবার্গের দুর্ধর্ষ ক্যামেরায় এই সব দৃশ্যগুলো ফ্রেমিং হবে আর দর্শকদের চোখ আটকে থাকবে তাতে। এসব দৃশ্য দেখতে দেখতে মনে হয়  আহা ক্যামেরাটা মিশর থেকে সরে গেলেই বাঁচি, এত খারাপ মিশরিয় জনগণ। তার সাথে সাথেই প্রায় স্পিলবার্গের অবচেতনেই হয়তো উঠে আসতে থাকে আমেরিকানদের আগ্রাসী চেহারা। এতগুলো দুবৃত্ত, এত ষড়যন্ত্র ইন্ডি একাই প্রতিহত করে বীরত্বের সাথে। যেন সে কোন অবতার। এই কালো স্বাস্থ্যহীন মানুষগুলার ভেতর। কালো মানুষগুলোর হাতে আছে ছুরি আর তলোয়ার। একসঙ্গে অনেকেই ইন্ডিকে আক্রমণ করে কিন্তু হঠাৎ ইন্ডি বন্দুক বার করে এক গুলিতেই সব নিকেষ করে।

‘টেম্পল অব দি ধুম’ পর্বে  দেখানো হয় চায়না আর ভারতকে। এ পর্বে আরও ভয়াবহভাবে উপস্থাপন করা হয় প্রাচ্যবাসীকে। ইন্ডি তখন সাংহাই। দুনিয়ার সবচাইতে বড় হিরাটি উদ্ধারের মিশনে। ক্রুর ষড়যন্ত্রকারী হত্যালুলুপ লোভী চায়নাদের হাত থেকে সে হিরা এবং সাদা নারী দুটিকেই হলিউডি  কৌশলে উদ্ধার করে বিমানে উড়াল দেয়। কিন্তু চায়নাদের নিষ্ঠুরতার এখানেই শেষ নয়। যেই মারামারিতে পরিশ্রান্ত ইন্ডি ঘুমিয়ে পড়েছে। বিমানের চায়নিজ ক্রু ও পাইলট তাদেরকে বিমানে ঘুমন্ত অবস্থায় ফেলেই প্যারাসুট নিয়ে ঝাপিয়ে পড়ে। অনিবার্যভাবে বিমান দুর্ঘটনা।
কিন্তু দুর্ঘটনা ঘটার আগেই ইন্ডিও সখিসমেত ঝাপিয়ে পড়ে বিমান থেকে। তারা বরফের পর্বতের ওপর পড়ে পিছলে যায়। এই বরফের রাস্তাই তাদের নিয়ে আসে ভারতবর্ষে। 

ভারতে ইন্ডির যে অভিজ্ঞতা হল তা যে কোনো ভয়ংকর কল্পনাকেও হার মানায়। ভারতে এসেই ইন্ডি দেখতে পায় অন্ধ বিশ্বাসী হাড় জিরজিরে গরীব লোকদের যারা একজন অবতারের জন্য অপেক্ষা করছে। তাদের দিয়া স্পিলবার্গ এই বাসনার জন্ম দেন যে ইন্ডিই সেই অবতার। ইন্ডির সিনা ফুলে উঠে।
প্রধানমন্ত্রীর দাওয়াত খেতে গিয়ে আরেক কা-। একি!  খাবার প্লেটে এতবড় বাচ্চা পেটের অজগর! হবে না ভারতীয়রাতো জীবন্ত অজগর খেতে খুব পছন্দ করে। এই রাজকীয় ভোজে ভারতের উজির নাজিররা খুব মজা করে অজগরের পেট কেটে কিলবিল করা কালো মসৃণ অজগরের বাচ্চাগুলা দুহাতে ধরে ধরে মজা করে কামড়ে খাচ্ছে। ইন্ডির চক্ষু ছানাবড়া হলেও সে অবাক হবার বা ভয় পাবার লোক নয়। কেবল ইন্ডির শ্বেতাঙ্গিনী সখির মাথা ঘুরছে সাপ দেখে। তাই সে একটু সামান্য সুপ চায় পরিবেশকদের কাছে। ধুমায়িত বাটিতে চামচ দিয়ে দেখে আরেক কাণ্ড একি! ভারতীয়রা মরামানুষের চোখের সুপ খায়? এবার সত্যি সত্যি মহিলা মুর্চ্ছা যায়। ভারতীয়রা এরপর খেতে থাকে একে একে তেলাপোকা ভাজি, বড় বড় মাকড়শা রেসিপি ইত্যাদি। 
তবে স্পিলবার্গের খাদ্য চিন্তা চমৎকারা বলতেই হয়। খাদ্যভক্ষণ শেষে ভারতিয়রা কি খায় জানেন? সদ্য কাটা বানরের মাথার গরম গরম মগজ। এই নিস্পাপ আমেরিকান ইন্ডিরা এই সব সভ্যতা বিরোধী কাজকর্ম দেখে অবাক মানে। শুধু ইন্ডি নয় দর্শকরা আমরা যারা ছবিটা দেখছি তাদেরও ভারতয়িদের প্রতি ঘৃণায় কুচকে যায় কপাল। আর ইন্ডির মত নিস্পাপ শুভ’র প্রতিনিধির জন্য মমতায় ভরে উঠে মন। হলিউডের বেশিরভাগ সিনেমায় বাস্তবতাকে উল্টে দেয়া হয়। মানে দুনিয়াব্যাপি আমেরিকানদের যেই হিংস্র সাম্রাজ্যবাদি চরিত্র, তাকে তারা বলে আবিস্কার। সিনেমায় নিরীহ দুর্বল অন্যমহাদেশকে এত খল করে দেখানোর ভেতর তাদের অবতার হয়ে উঠার সুক্ষ রাজনীতি জড়িত আছে।দুনিয়াব্যাপী মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের সামাজীকিকরণ ঘটানো হয় পরিকল্পিতভাবে হলিউডে। মানুষ নেহায়েত বিনোদন হিসাবে দেখতে গিয়ে নিজের ধ্যান ধারণা হারায় হলিউডের হাতে।

না, এখনো শুরুই হয়নি অসভ্য ভারতিয়দের হিংস্রতা। ভারতিয় বাজারি  ছবির জনপ্রিয় অভিনেতা অমরেশপুরী এক ভয়ংকর দৈত্য (বলরাম) যার মাথায় সবসময় ষাড়ের শিংয়ের ট্রুপ। আর মুখে মা কালির নাম। এমন দৈত্য কে দেখেছে আগে? যে জীবন্ত মানুষের বুকের ভেতর হাত ঢুকিয়ে হাতের মুঠোয় কলিজা নিয়ে খুশিতে চীৎকার করে বলে ‘আব ইসকি জান মেরি মুট্টি মে হ্যায়, মা কালী...’। 
তার পর সেই লোকটিকে আগুনের ভেতর আস্তে আস্তে নামিয়ে দেয়া হয়। সে এক বিভৎস দৃশ্য। এমন ভয়ানক দৃশ্য কে দেখেছে স্পিলবার্গের আগে।
এই ছবির সবচাইতে মজার দৃশ্য শেষ দৃশ্য। ইন্ডি ভারতের আপমর জনতাকে অমরেশপুরির হাত থেকে রক্ষা করার মিশনে নামে। মা কালির মনিমুক্তা নিয়ে পালানোর পথে আবার দলবলসহ অমরেশপুরী ঝাপিয়ে পড়ে ইন্ডির ওপর। একটা সেতুর দুইদিক থেকেই ভারতিয়রা আক্রমণ করে ইন্ডিকে। এই সেতু এমন এক নদীর ওপর যার নীচে কিলবিল করছে ভয়ংকর কুমির। ইন্ডির এই বিপদ দেখে ভারত শাসনরত ব্রিটিশ সৈন্যরা ইন্ডির পক্ষ হয়ে যুদ্ধ শুরু করে। একদিকে তীর-ধনুক নিয়ে হাস্যকর ভারতিয় সৈনিক অন্যদিকে বন্দুক হাতে ব্রিটিশ সৈন্য। শেষমেষ ইন্ডিই জিতবে এটাতো হলিউডের আইন।
শুধু স্পিলবার্গ নয় হলিউডের এই সিনেমা ব্যবসায়ের সাথে জড়িত যেই মিডিয়ামোগলরা তারাও কর্পোরেটোক্রেসির অংশ। তাদের এই ‘অপর’ তৈরির যে নীলনকশা তা হারহামেশাই সংস্কৃতির মাধ্যমগুলাতে সাটা থাকে। এই যে ‘অপর’ মানে টেররিস্ট। আর নিজে অ্যান্টিটেররিস্ট। এই জন্য হলিউডের বেশিরভাগ ভিলেন থাকে এই অপর। রাশিয়ান কমিউনিস্ট অথবা কিউবান কমিউনিস্ট  অথবা মধ্যপ্রাচ্যের কোনো মুসলমান। অর্থাৎ দুনিয়াকে লুট করতে গিয়ে যাদের কাছে তারা বাধা পায়। তারাই তাদের অপর। হলিউডি সিনেমা ব্যবসার অন্তরালে মূলত এই অপর তৈরির সংস্কৃতিক নীলনকশা।

যাইহোক একজন আমেরিকান হিসাবে স্পিলবার্গ যে বিশ্বস্ত দেশপ্রেমিক সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নাই। আর বিশ্বস্ত আমেরিকান মানে একজন অ্যান্টিটেররিস্ট যিনি টেররিজমের মাধ্যমেই তাকে বধ করে। একজন ইন্ডি বা স্পিলবার্গের মনের ভেতর লুকানো জিনিসটাকেই বলে সাম্রাজ্যের বাসনা বা সাম্রাজ্যের মন।  রেইডার্স অব দি লস্ট আর্ক টেম্পল অব ধুম ছবি দুটিতে ইন্ডির চরিত্রটা বিশ্লেষণ করলে কিন্তু পুরা সাম্রাজ্যের মনটাকে বুঝতে পারা যায়।

ইন্ডি একজন আর্কিওলজিস্ট। যে কোন দুর্লভ সংগ্রহের জন্য সে এক পায়ে খাঁড়া। প্রথম ছবিতে বাদশাহ সোলেমানের যাদুর বাকসোটা যেটার ভেতর নাকি অমর হবার রশ্মি লুকায়িত আছে। যার জন্য স্বয়ং ফুয়েরার হিটলার পাগল। নাজিরা দুনিয়াটা চষে ফেলছে বস্তুটির জন্য। তা শেষ পর্যন্ত ইন্ডিই বগলদাবা করে। অবশেষে সেটা যখন আবার নাজিরা দখল করে তখন দেখা যায় সেই যাদুর বাকসোর ভেতর হতে বের হওয়া রশ্মিতে  নাজিরাই পুড়ে ছারখার হয়ে যায়। 

স্পিলবার্গ ইহুদির সন্তান। নাজিবিরোধীতা তার রক্তে। কিন্তু এই চলচ্চিত্রে সু আর কু এর যুদ্ধে ইন্ডি হচ্ছে সু আর শক্তির অধিকারি, বাকীসব কু আর অশুভশক্তির প্রতিনিধি। এই ছবিতে দেখানো এশিয়া আর আফ্রিকার মানুষদেরকে নাজিদের একই লাইনে এসে শেষতক এমন এক সিদ্ধান্তে দর্শক আসে যে নাজি আর এশিয়া-আফ্রিকানদের তথা প্রাচ্যেবাসীদের মধ্যে কোন তফাৎ নাই। তারা সবাই ইন্ডি বা আমেরিকানদের মত সহজ সরল মানুষদের হত্যা করতে চায়। 

ইন্ডিয়ানদের যে খাদ্য তালিকা টেম্পল অব ধুমে দেখানো হয় তাও প্রাচ্যবাসিদের রাক্ষসের সমকক্ষ করে। এমন উপাদান দিয়ে ছবি গুলো বানানো হয়, স্পিলবার্গের অধিকাংশ ছবিই স্বপরিবারে একসাথে দেখার মত। এখন প্রশ্ন হচ্ছে স্পিলবার্গে মত আবেগী, দক্ষ, জনপ্রিয় একজন পরিচালক যার ছবি শত শত ইউরোপ আমেরিকার শিশুদের প্রিয়। তারা কি ভাবছে এই সব ছবি দেখে সে কথা তিনি যে জানতেন না তা তো নয়। বরং তিনি উল্লসিত ছিলেন। এবং খুব সুক্ষভাবে এই কাজ তিনি করেছেন, 'অপর'কে শনাক্ত করার বাসনায়। কারন তার মত ডিটেলে কাজ  করে এরকম পরিচালক জগতে খুব কম। এই ডিটেলস নিয়ে চিন্তা করার সময়। প্রত্যেকটা সিকোয়েন্সের কথা তিনি ভেবেছেন, প্রত্যেকটা সিকোয়েন্সের, ফ্রেমের, গতির প্রতিক্রিয়ার কথা তিনি ভেবেছেন। তার রাজনীতির সচেতনতা প্রতিটি শটেই প্রমাণিত। চলচ্চিত্রের ইতিহাসে স্পিলবার্গকে বলা হয় নীতিবাদি পরিচালক। তার প্রায় ছবিতে অভিনেতা বা মুটিভ অমানবিক এক শক্তির কাছে নিজের নিরাপত্তার নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে আবার নিজের চেষ্টায় তা ফিরে পায়। কিন্তু পৃথিবীতে সব সময় দুই শ্রেণির মানুষের নীতি দুই রকম। একজন আমেরিকান হিসাবে স্পিলবার্গের যে নীতি তা প্রাচ্যের একজন চলচ্চিত্রকারের একই নীতি নয় নি:সন্দেহে। 

আর তাই ইন্ডিয়ানা জোন্সের নীতি আর চীন ভারত মিশরের তথা প্রাচ্যে নীতি একরকম নয়। প্রাচ্যের চোখে ইন্ডি একজন লোলুপ কিডন্যাপার ছাড়া কিছু নয়। যেভাবে প্রাচ্য দেখে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদকে।। যেভাবে আমরা আজ দেখছি মার্কিন সাম্রাজ্যবাদকে। স্পিলবার্গও বুঝেছেন যে এটাই সত্য আর তাই তাকে মিশরি বা ভারতিয়দের খারাপ বানাতে হয় তার মুভিম্যাজিকের মাধ্যমে যেন যারা প্রাচ্য সম্পর্কে জানেনা তারা প্রাচ্যের খারাবি সম্পর্কে তথা 'অপর’এর স্বভাব ও শনাক্তি সম্পর্কে যেন কোনো প্রশ্ন তুলতে না পারে। এটাই সাম্রাজ্যের সাংস্কৃতিক রাজনীতি বা অপর শনাক্তের নীতি। প্রকারান্তরে এই ছবি দুটোর মানসিকতাই হয়ে উঠে সাম্রাজ্যবাদিদের লাস্ট ক্রুসেডের মেটাফোর।



Wednesday, May 29, 2013

ব্যাংক ও কর্পোরেট দুনিয়ার সাহিত্য পুরস্কার

বাংলাদেশে সম্প্রতি বিভিন্ন বাণিজ্যিক ব্যাংক ও কর্পোরেট হাউজগুলোর আলাদা বা যৌথভাবে সাহিত্যের নামে পুরস্কার দেয়ার হিড়িক পড়েছে। এত ডাকঢোল বাজিয়ে এসব ব্যবসা প্রতিষ্ঠান কেন সাহিত্যের নামে পুরস্কার দিচ্ছে ব্যাপারটা ভেবে দেখবার মতো। প্রথমে ব্যংকের কথাই ভাবি, ব্যাংকের কাজ সম্পর্কে মোটামুটি সবাই জ্ঞাত। এটা এমন এক বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান, যার সবই সুদের ফটকা ব্যবসা। ব্যাংক সঞ্চয়মুখি জনগণের কাছ থেকে সাধারণ সঞ্চয়সহ বিভিন্ন স্কিমে জামানত হিসাবে টাকা সংগ্রহ করে আর চালু ব্যবসায়ীদের সেই টাকা ঋণ দেয়। যাদের কাছ থেকে ব্যাংক নিজে জামানত নেয় তাদের সুদ দেয় কম, আবার যাদেরকে তারা সেই টাকা ঋণ দেয় তাদের কাছ থেকে চড়া সুদ নেয়।

বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে চালু ব্যবসা কী? মোটা দাগে গার্মেন্টস সেক্টর, ওষুধ সেক্টর, প্লট বা ফ্ল্যাট ব্যবসা, খাদ্য ব্যবসা ইত্যাদি। ক্ষুদ্র অনেক ব্যবসা থাকলেও বৃহৎ পুঁজি খাটে উল্লেখিত ব্যবসায়। আবার এই ব্যাংকও বহুজাতিক ব্যবসা চক্রের অংশ। একেকটা বহুজাতিক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে এখন সব ধরনের ব্যবসায় বিনিয়োগ থাকে। এরা এমন ব্যবসাচক্রের প্রসার করছে একই কোম্পানির বস্ত্রব্যবসা, ওষুধ ব্যবসা, খাদ্য ব্যবসা, শিক্ষা ব্যবসা, রিয়েল এস্টেট ব্যবসা, চিকিৎসা ব্যবসা, মিডিয়া ব্যবসা, ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের ব্যবসা থেকে শুরু করে সব ধরনের ব্যবসা করে থাকে। এরকমও হতে পারে যে এক কোম্পানির টিভি বা পত্রিকায় চমৎকার বিজ্ঞাপন দেখে ভাল প্যাকেটে খারাপ খাদ্য খেয়ে অসুস্থ হয়ে গেলেন, ভর্তি হলেন এই একই কোম্পানির হাসপাতালে, চমৎকার সাজসজ্জার হাসপাতালে গলাকাটা দামে চিকিৎসা করলেন, খেলেন এই একই কোম্পানির নিম্নমানের ওষুধ; তাও চড়াদামে। চিকিৎসার অবহেলায় আপনার মৃত্যু হলে মিডিয়া তা চেপে যাবে, কারণ মিডিয়াও এই একই কোম্পানির। মোটকথা আপনি এসব বহুজাতিক কোম্পানির দখলে। এই বহুজাতিক কোম্পানি টিকিয়ে রাখতে গেলে তার একটা রাজনৈতিক রূপরেখা দরকার। ফলে রাজনীতিটাও, পক্ষান্তরে ক্ষমতাটাও এদের হাতে।

এখন বিচ্ছিন্ন করে এই ব্যবসাগুলো দেখা যাক। গার্মেন্টের ব্যবসা সম্পর্কে এদেশের সচেতন মানুষ খোঁজখবর রাখেন। রানাপ্লাজা, তাজরিন, স্পেকট্রাম, স্মার্টের ঘটনার পর গার্মেন্টসের অনেক খবরাখবর জনগণ পাচ্ছেন। এটা সম্পূর্ণ লুটপাটের জায়গা, শ্রমিকদের রক্তে অমানবিক এক পুঁজিবানানোর হাবিয়া দোযখ। লাখ লাখ শ্রমিক কাজ করে এই সেক্টরে। মাসে তিন হাজার টাকা বেতন দিয়ে যাদেরকে কমপক্ষে ১৫ হাজার টাকার পরিশ্রম করিয়ে নেয়া হয়। বাকী ১২ হাজার টাকাই মালিকের লাভ। দিনের পর দিন এই একই শোষণ প্রক্রিয়া, অমানবিক দাসত্বের পরিবেশে তাদের বেঁচে থাকার সমস্ত সম্ভাবনাকে নস্যাৎ করে দিয়ে গুটিকয় মানুষের পুঁজি তৈরির কারখানা এসব। এই খাতে ব্যাংকগুলার রয়েছে বিশাল বিনিয়োগ, হয়ত বাংলাদেশে সবচাইতে বেশি ঋণ দেয়া হয় এই সেক্টরে।

চিকিৎসা সেবা মানুষের নৈতিক অধিকার হলেও, ওষুধপথ্য বিনা পয়সায় পাওয়ার কথা থাকলেও বর্তমানে বাংলাদেশে সবচাইতে জল্লাদ ব্যবসা হচ্ছে চিকিৎসাব্যবসা। চিকিৎসা করাতে গিয়ে আর অষুধ খেতে গিয়ে জীবনের সমস্ত সঞ্চয় শেষ হয়ে গেছে অনেক মানুষের। এই যে অষুধ বানানোর শ্রমিক, তা বিক্রির শ্রমিক- তাদেরকেও অবিকল একই কায়দায় তাদের শ্রম থেকে বঞ্চিত করা হয়। ঠিক এভাবেই বাসস্থান, খাদ্য, শিক্ষা ইত্যাদি মৌলিক অধিকার এখন এদেশে সবচাইতে লাভজনক ব্যবসা।

এই প্রত্যেক ব্যবসার টার্গেট বা ভোক্তা হচ্ছে সাধারণ মানুষ। সাধারণ মানুষকে অতিদামে নিম্নমানের চিকিৎসা দিয়ে, সাধারণ মানুষের রক্ত ও ঘাম থেকে শ্রম ঘণ্টা মেরে দিয়ে, সাধারণ মানুষকে পুষ্টি কম দিয়ে অর্থাৎ তাকে দুনিয়ায় তার সাংবিধানিক অধিকারকে তার কাছে বিক্রি করে তার ভেতর থেকে গুটিকয় মানুষকে মুনাফা তথা পুঁজিপতি বানানো এবং তার ঋণের চড়া সুদে নিজের দেহ আরো প্রসারিত ও নিজের ফাটকা ব্যবসার আরো বিস্তার ব্যাংকের মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। সেই লাভেরই এক ক্ষুদ্র অংশ সে ব্যবহার করে তার বিরুদ্ধে যেন কোনো জনমত গড়ে না উঠে। বহুজাতিক কোম্পানিগুলাতো তাদের পক্ষে সম্মতি উৎপাদন করে তাদের নিজস্ব পত্রিকা ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া দিয়ে। তাই সামাজিক সুনাম যে সমস্ত বিষয়ের সাথে জড়িত সেখানে সে সামান্য বিনিয়োগ করে তার সুনাম বাড়িয়ে তোলার জন্য। তথাকথিত এই সাহিত্য পুরস্কার এরই অংশ।

আর অন্যদিকে সাহিত্যের কাজ প্রায় সম্পূর্ণই এর বিরোধী। সাহিত্যকে বলা হয় হিতের চেতনা। সাহিত্যকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারা অনেকাংশে একটা জাতির চেতনাকে নিয়ন্ত্রণ করার মতোই। ব্যাংক বা বহুজাতিক কোম্পানিগুলার যদি বাংলাদেশের সাহিত্য নিয়ে এতই দায়িত্ববোধ থাকত, তাহলে তারা প্রকাশকদের আন্তর্জাতিক প্রশিক্ষণ দিয়ে প্রচুর ঋণ দিতে পারত। বইয়ের গুণগত মান বাড়িয়ে, লেখককে তাদের রয়ালিটি নিশ্চিত করে, বই উৎপাদন ও তা বিক্রয়ের জন্য গোটা দেশে একটা চমৎকার নেটওয়ার্ক তৈরি করে গণচেতনার সৃষ্টি করতে পারত। বাংলাদেশে ষোল কোটি এবং কলকাতায় মিলিয়ে গোটা দুনিয়া প্রায় আরো দশ কোটি বাঙালি বাংলাভাষায় কথা বলে, পড়ালেখা করে। ১০ থেকে ১২ কোটি ভাষাভাষি ফ্রান্স, রুশ, ইত্যাদি ভাষার সাহিত্যবাজারটা অনেক বড়। ২৬ কোটি বাংলাভাষিদের মধ্যে এক কলকাতার সাহিত্যবাজার ছাড়া বাংলাদেশের বাংলাসাহিত্য বাজার নাই বললেই চলে। তার উপর ঢাকাসহ দেশের বিভাগীয় শহরের বড় বইয়ের দোকানগুলা কলকাতার বইয়ের দোকান। আর মফস্বলে মকছুদুল মোমেনিন বা হাশরের পরে জাতীয় বই ছাড়া ভাল মানের কোনো সাহিত্য পাওয়া যায় না বললেই চলে। ভেতরে এরকম নানা জটিলতা রেখে কয়েকজনকে সাহিত্যের নামে এত বাজনা বাজিয়ে পুরস্কার দেয়াটা অনেকটা পোকায় খাওয়া গর্ত ঢাকা দেয়ার জন্য কার্পেট বিছানোর মতই।

অথচ ব্যাংক ও বহুজাতিক বেনিয়ারা যা করে তা হচ্ছে গুটিকয় ব্যাংক মালিকদের বা লিয়াজোকারীদের আত্মীয়স্বজনকে লেখক নাম দিয়ে পুরস্কার দিয়ে সাহিত্য জগতে একটা বিভ্রান্তির সৃষ্টি করছে। সাহিত্যের মানে তাদের কিছু আসে যায় না। দেখা যাবে যে কজনকেপুরস্কার দেয়া হয় অল্প টাকা। তার অনেকগুণ বেশি খরচ করা হবে প্রচারণায়, বিজ্ঞাপনে, বিলবোর্ডে, অতিথি আপ্যায়ণে, অডিটোরিয়ামের সাজসজ্জায়। উপস্থিত করবে ক্ষমতাধর কোনো মন্ত্রী; যার আবার গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে। পুরস্কার প্রদানের পর আবার বিজ্ঞাপণ, আবার প্রচারণা। মূলত এই প্রচারণাই তাদের লাভ।

একাধিকবার এইভাবে লাগাতার পুরস্কার প্রদানের প্রভাব জনমনে স্থায়ী হয়। এটা সংস্কৃতিরই অংশ হয়ে উঠে। যেহেতু সাহিত্য পঠনপাঠনেরই বিষয়। সাহিত্যর কথা উঠলেই সাথে ভেসে উঠবে সেই সব ব্যাংকের নাম, বহুজাতিক কোম্পানিগুলার নাম, যা সাহিত্য পুরস্কার প্রদান করেছে। তখন সমাজ ব্যাংককে বা বহুজাতিক কোম্পানির সব শোষণ ভুলে সেসবকে হিতকারী প্রতিষ্ঠান হিসাবে গণ্য করবে। না হলে সাহিত্যের মতো একটা অলাভজনক কিন্তু প্রচারবহুল জায়গায় ব্যাংক বা বহুজাতিক কোম্পানিগুলার কী কাজ?

প্রশ্ন উঠতে পারে কাদেরকে দেয়া হবে সে সব পুরস্কার? ব্যাংকের টার্গেট থাকবে কোনো সিরিয়াস লেখককে সেই পুরস্কার দিতে। কিন্তু সত্যিকার অর্থে একজন লেখক এই পুরস্কার গ্রহণের আগে যেহেতু পুরস্কার দাতার স্বভাব ও উদ্দেশ্যের নেতি নিয়ে প্রশ্ন করবে। এবং অবশ্যই এসব প্রতিষ্ঠান তাদের এই পুরস্কার নিয়ে বিতর্ক তৈরি করবে না। তাই পুরস্কার দেয়ার আগে তারা সেই লেখকের সাথে কথা বলবে। এই সমস্যা এড়ানোর জন্য ব্যাংক খোঁজে বার করবে সাহিত্যিক ব্যবসায়ীদের; যারা অনেক আগেই নিজেদের আত্মা বিক্রি করে দিয়ে হাজির হয়েছে এখানে। আর রুজ লাগিয়ে অপেক্ষা করছে সড়কে পরবর্তী খদ্দেরের আশায়। এদের বাস সাহিত্যের কানাগলিতে, এরা সবখানেই আছে, এরা বহুরূপী। ব্যাংকের যেহেতু লেখার গুরুত্ব নিয়ে কাজ নাই সেহেতু সাহিত্যের নামে যে কোনো কিছুকেই তারা পুরস্কার দিতে পারে। এরা এই আত্মাবিকৃত জীবগুলি যারা ঘোরাফেরা করবে নিয়ত ব্যাংকের এজেন্টদের আশপাশ; এবং এরাই এইসব পুরস্ককারের যোগ্য। সত্যিকার অর্থে দেখা যায় এ পর্যন্ত কোনো ভাল লেখককে ব্যাংক পুরস্কৃত করতে পারে নাই, পারবেও না। কারণ সাহিত্য কোনো কিছুর বিনিময়ের জন্য তৈরি হয় না। এটা দায়বোধের ব্যাপার। এই পুরস্কার নেয়ার মাধ্যমে অনেক ভাল লেখকও নিজের আত্মা বিক্রয়ের সুযোগ পায়। বিনিময়ে তাকে পণ্য করে তাঁরা, তাকে দেয়া অর্থমূল্যের বহুগুণ সুনাম বাজার থেকে তুলে নেয় ব্যাংক বা বহুজাতিক কোম্পানিগুলা। আমাদের জীবদ্দশাতেই এরকম বহু লেখককে তাদের যুদ্ধাংদেহি পোশাক খুলে নাচের পোশাক পরতে দেখেছি আমরা।

তবু এখানেও ব্যাংক বা কোম্পানিগুলা ভাড়ামো করবে, তারা বই আহ্বান করবে, আহ লুম্পেনরা দলে দলে প্রতারিত হতে যাবে সেখানে। তার বুঝতেও অক্ষম এই পুরস্কার অনেক আগেই দেয়া হয়ে গেছে তাদের বাছাই করা দালালদের। যতই আনুষ্ঠানিকতা ততই প্রচার এটাই তাদের লাভ। এমনিতেই গত চল্লিশ বছরে দায়বোধের জায়গায় এদেশের সাহিত্য প্রায় শূন্যের কোটায়; যা এখনো এদেশে সাহিত্য বলে আমরা পড়ছি তা চল্লিশ বছর মানে ৭১’র আগে জন্ম নেয়া। এরপরের সাহিত্যকে বলা যায় হাইব্রিড সাহিত্য। ফেনানো, যার মধ্যে আবহমান বাংলার সাধারণ মানুষের সংগ্রামের কোনো ধারাবাহিকতা নাই। বাংলাদেশের অন্যান্য সেক্টরের মতই এখানেও সচেতনভাবে গড়ে তোলা হচ্ছে সিন্ডিকেট। এখানেও গড়ে উঠেছে চিছকে মাস্তানদের দৌরাত্ম্য। বহুজাতিক কোম্পানিগুলা তাদের বাধাধরা দালাল কবিদের দিয়ে কবিতা সংকলন, গল্প সংকলন ইত্যাদিও করাচ্ছে। তাতে ঢোকানো হচ্ছে বাছা বাছা দালাল কবি, সাহিত্যিক নামের প্রাণিদের। যাদের লেখার সাথে সাহিত্যের কোনো সংযোগ নাই।

Saturday, April 27, 2013

সাভার ট্রাজেডি: যেখানে ভাষা কাজ করে না



জানিনা কেন যাই। কোথা থেকে আসে এই টান। হয়তো সংবেদনশীলতা থেকে। সংবেদনশীলতা এক ধরনের পাপ। অনুশোচনা। যেন বা নিজের কাছে নিজের কনফেশন। চাকরি বাকরি থাকলে হাসফাস লাগে। অইদিকে মানুষ মরছে আমি এইখানে চাকরি করছি। মনে হয় সাভারে যারা ভবনের দেয়ালে আটকে আছে তাদের মত আমরাও। এরচেয়ে ভাল নাই এদেশের মানুষ। যেদিন ভবন ধ্বসে পড়ে সেদিন সহ্য করি। কাদঁতে থাকে অন্তস্থল। রাতে ঘুমাইতে পারি নাই। বিভিন্নভাবে নিজেরে কল্পনা করি, মনে করি আমার কোমর শুদ্ধ উপরে আটকানো শুধু পাটা ঝুলে আছে নিচে। তখন আমার কেমন লাগবে? চেতনাওকি দুইভাগ হয়ে যাবে তখন? আবার ভাবি। শুধু গলা থেকে মাথাটা আটকানো বাকীটা কোথায় জানিনা তখন কিরকম লাগবে? কোথায় যেন একটা সিনেমা দেখছিলাম নির্মানাধীন একটা ব্রিজের নিচে হেটে যাচ্ছিল কিছু মানুষ হঠাৎ ব্রিজ থেকে লোহার অজস্র রড পড়ে মানুষগুলার উপর প্রায় সবাই গেঁথে যায় সেই রডে। যাইহোক সকালে ঘুম ভাঙ্গে মাথাব্যাথা নিয়ে। ফোন দিই আরেক নিশি পাওয়া মানুষ বাতেন ভাইকে। উনিও ক্ষতস্থান না দেখে শান্তি পান না। সাভার যাওয়ার জন্য তিনিও এক পায়ে খাড়া।

অনেক ঘুরে যেতে হয়। গাবতলীর দিকে গাড়ি ঢুকতে দেয় না। আমরা ভেতর দিয়ে বেড়িবাধে উঠি। আশুলিয়া বাজার থেকে ভেতরের পথ ধরি। আস্তে আস্তে মানুষের যাত্রা শুরু হয়। অজস্র মানুষ, সবাই হাটছে, নীরবে। যেন কোনো অনন্ত শবযাত্রা। শুধু দৃশ্যগুলো খেলা করে। লোহার রড়ে গেঁথে যাওয়া মানুষ, কোমর পর্যন্ত দেখা যাওয়া মানুষ। শুধু মাথাটা আটকে থাকা মানুষ। আরো গভীরে আটকে পড়া অজস্র এখনো বেঁচে থাকা মানুষের আহাজারি পানি.. .. পানি.. ..। 
আদ্র হয়ে আসে দুনিয়ার বাতাস। প্রায় দুইকিলোমিটার আগে থেকে এত মানুষের নীরব মিছিল যে গাড়ি নিয়ে আর আগানো যায় না। কেউ কারো সাথে কথা বলিনা। অবসাদ আর বিষণ্নতা ঘিরে ফেলে আমাদের। গাড়িটা এক জায়গায় রেখে নীরব মানুষের মিছিলে মিশে যাই। জানি সবার ভিতরে একাধিক চলচ্চিত্র। ভিতরে সবাই চলমান। 

সাভার বাজারের দিকে আগাতেই চোখে পড়বে হরেক রকমের পোষ্টার। ’সাভারের মাটি, মুরাদ জংয়ের ঘাটি’। যেন সাভার কোন ব্যক্তির ঔপনিবেশ। চোখে কালো সানগ্লাস দেয়া কোন ভিলেনের মত, কোনটা পাঞ্চাবি গায়ে দেয়া, কোনটা টি শার্ট পড়া। যে কোনো ধরনের পোষ্টারের সাথেই এই মুরাদ জংয়ের ছবি। চোখের জন্য পিড়াদায়ক, রীতিমতো অশ্লীল। তার একক ক্ষমতা বলে যে সাভারের মাটিতে সবই সম্ভব সেটা বোঝা যায় এই কর্মকা- থেকে। যতই ঘটনাস্থলের দিকে আগাতে থাকি ততই ভিড় বাড়তে থাকে। ততই দেখা মেলে অজস্র স্বেচ্ছসেবিদের। কেউ বিনা পয়সায় পথচারীদের পানি খাওয়াচ্ছে। কেউ মানুষকে একপাশে ঠেলে দিচ্ছে যেন অ্যাম্বুলেন্স টানার পথ আটকে না যায়। একটু পর পরই আহত ও নিহতদের নিয়ে ছুটছে মিনি ট্রাক আর অ্যাম্বুলেন্স। আমরা সচকিত হয়ে আরো বেশি সংকুচিত করছি নিজেদের। টেনে নিয়ে আসছি রাস্তার কিনারে। যেন পথটা আটকে না যায়।

আমরা সাংবাদিক ম্যাজিস্ট্রেট বলে ঢুকে পড়ি মুল জায়গায়। যেখানে যেতে দিচ্ছে না মানুষকে। আমার হাতে বাতেন ভাইয়ের ক্যামেরা, বাতেন ভাই বলছেন পারলে ছবি তোলো। আমি বিরক্ত হচ্ছি আমার হাত কাজ করছে না। আমি তাকিয়ে আছি এক নজরে ঘটনাস্থলের দিকে। বুঝতে চেষ্টা করছি, যেখানে দালানটি দাঁড়িয়ে ছিল তার একপাশে মিশে গেছে মাটিতে। অন্যপাশে এখনো একতলা সমপরিমাণ আটকে আছে। একেক ছাদের উপর ভাজ হয়ে আছে বাকি ছাদগুলো। চলছে উদ্ধারকাজ। রাস্তার অন্যপাশে মাইক হাতে সেনাবাহিনী। লোকজনকে সরিয়ে দেবার তোড়জোড় করছে। দাঁড়াতেই দিচ্ছে না লোকজনকে সেখানে। আশপাশের সমস্ত দালান লোকে ভর্তি। কোন কোন দালানের গ্লাসভেঙ্গে দেখছে লোকজন। মনে হচ্ছে ভেতর থেকে অজস্র আহত মানুষ ডাকছে আমাদের যাদের আমরা কোনোদিন দেখি নাই।

আহ পুঁজিবাদের বলি শ্রমিক শ্রেণি। বহুজাতিক কোম্পানি পণ্য তৈরি করতে গিয়ে আর কত মরবে তৃতীয় বিশ্বের জনগণ। পুঁজিবাদ যে কিরকম অবিবেচক ও অমানবিক তার স্মারক হয়ে আছে সাভার ট্রাজেডি। তাদেরকে রীতিমতো হুমকি ধামকি দিয়ে বন্দি করা হয়েছে। ভবনে ফাটল, ভবন পড়ে যেতে পারে এই আশংকায় ছিল সবাই। কিন্তু পুঁজিবাদের কাছে এইগুলা মানুষতো না মেশিন। মেশিনের আবার বাঁচামরা কি যতক্ষণ বেঁচে আছো ততক্ষণ উৎপাদন করো। মুনাফা দাও। কারণ তৃতীয় বিশ্বের শ্রমিকের মতো পশুতো দেখা দেয় নাই আর ইহজগতে। দুইতিন ঘণ্টার টাকায় ১২/১৩ ঘণ্টা শ্রম। প্রতিটি শ্রমিকের প্রায় দশঘণ্টার শ্রম চুরি করে কারখানা মালিক। 

মহাত্মা কার্ল মার্কসের কথা মনে পড়ে যায় ’বুর্জোয়া শ্রেণি যেখানেই প্রাধান্য পেয়েছে, সেখানেই সমস্ত সামন্ততান্ত্রিক, পিতৃতান্ত্রিক, নির্দোষ সরল সম্পর্ক খতম করে দিয়েছে। যেসব বিচিত্র সামন্ততান্ত্রিক বন্ধনে মানুষ বাঁধা ছিল তার ’স্বাভাবিক উধ্বতনের’ কাছে, তা এরা ছিড়ে ফেলেছে নির্মমভাবে। নগ্ন স্বার্থ ছাড়া, নির্মম নগদ লেনদেন ছাড়া এরা মানুষের সঙ্গে মানুষের আর কোনো সর্ম্পকই স্বীকার করে না। আত্মসর্বস্ব হিসাব-নিকাশের বরফজলে এরা ডুবিয়ে মেরেছে ধর্ম-উন্মাদনার প্রশান্তদিব্য ভাবোচ্ছ্বাস, শৌর্ষমণ্ডিত উৎসাহ ও কুপমণ্ডুক ভাবালুতা। ব্যক্তিমূল্যকে এ রূপান্তিরত করেছে বিনিময়মূল্যে, অগণিত সনদবদ্ধ স্বাধীনতার স্থানে এনে খাড়া করল ঐ একমাত্র, বিবেক বুদ্ধি চালিত নয় এমন, স্বাধীনতা অবাধ বাণিজ্য। এক কথায়, ধর্মীয় ও রাজনৈতিক মোহে অবগুণ্ঠিত শোষণের বদলে এ এনেছে নগ্ন, নির্লজ্জ প্রত্যক্ষ, পাশবিক শোষণ।’ –-কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো।

এই বুর্জোয়া সমাজ একটা চেইনের মতো ধারাবাহিক অর্থনৈতিক বন্ধনে আবদ্ধ। যেমন ক্ষমতাসীন পার্টির এমপি বলে মুরাদ জং ক্ষমতাবান। মুরাদ জংয়ের শিষ্য বলে রানা প্লাজার মালিক সোহেল রানা ক্ষমতাবান। সেই ক্ষমতাবলেই চারতলার দালান কোনো রকম অনুমোদন ছাড়াই নয়তলা পর্যন্ত তোলা হয়। এতে কোটি কোটি টাকা আয় হয়। মুনাফার লোভে লোপ পায় মানবতা বিচারবোধ। সেই ভবন বিপজ্জনক জেনেও বহুজাতিক কোম্পানির দেশিয় দোসররা চাকরি খতমের হুমকি দিয়ে হাজার হাজার শ্রমিককে কারখানাবন্দি করে কাজ আদায় করতে থাকে। যতকাজ তত মুনাফা। জীবনের মূল্য কি যদি তা দিয়ে মুনাফা বানানো না যায়। এ ঘটনাতো নতুন নয়, তাজরিনে সেদিন শত শত শ্রমিক জীবন্ত দগ্ধ হলো একটার পর একটা ঘটেই চলেছে শ্রমিক হত্যাকা-। শ্রমিক তারাতো মেশিন, মানুষ না। রাষ্ট্রতো বুর্জোয়াদের পাহারাদার। রাষ্ট্রতো টিকিয়ে রাখে বুর্জোয়ারাই, বিজিএমইয়ের মালিকরাই। রাষ্ট্র কেন শ্রমিকদের স্বার্থ দেখবে?

মহামতি লেলিন বলেন ’ রাষ্ট্র হলো একটি শ্রেণির উপর অন্য একটি শ্রেণির আধিপত্য বজায় রাখার যন্ত্র। .. .. বলপ্রয়োগের একটি স্থায়ী যন্ত্র ছাড়া সমাজের সংখ্যাগরিষ্ট অংশকে অন্য অংশটির জন্য নিয়মিতভাবে খাটতে বাধ্য করা যায় না।.. ..  যদি দাসরাষ্ট্রের কথা বলা হয়, দাসদের মানুষ বলে গণ্য করা হতো না, তাদের যে শুধু নাগরিকের মধ্যে ধরা হতো না তাই নয়, তাদের মানুষের মধ্যেই ধরা হতো না। রোমান আইন অনুসারে তার ছিল অস্থাবর সম্পত্তি। ব্যক্তিগত নিরাপত্তার অন্য সব আইনের কথা তো ছেড়েই দিলাম, নরহত্যার আইনও দাসদের বেলায় খাটতো না।.. ..  দাসের উপর অত্যাচারতো করা যেতই, তাকে খুন করাটাও অপরাধ বলে গণ্য হতো না।-রাষ্ট্র।

এখনোতো তাই আসলে। আধুনিক বুর্জোয়া রাষ্ট্রে শ্রমিক ও মালিকের সম্পর্ক সেই দাসমালিক ও দাসদের চেয়ে উন্নত নয়। এখন চলবে ধনিদের বাঁচানোর ক্ষমতাবানদের বিভিন্ন হাস্যকর ভাঁড়ামি। পৌরযুবলীগের সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক হিসাবে পোস্টারে পোস্টারে ছেয়ে আছে সাভারের দেয়াল। অথচ প্রধানমন্ত্রী সংসদে বলছেন সোহেল রানা যুবলীগের কেউ নয়। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লোক হাসাচ্ছেন, বিরোধী দলের উপর দোষ চাপিয়ে দেবার হাস্যকর রাজনীতি করছেন।

ফেরার সময় বাতেন ভাই বলছেন এই যে এত লোক একরাস্তা ধরে আসছে ঘটনা দেখে অন্য রাস্তা দিয়ে চলে যাচ্ছে নীরবে। এদের মনে কি কোনো প্রশ্ন জাগে না? জাগে না দাসত্বের ভেতর থাকতে থাকতে। এখন দাসত্বই আমাদের ভাল লাগে।

Wednesday, April 24, 2013

বন্দিশালা, আউৎসভিজ অথবা বস্ত্রকারখানা



ভবনের নীচে চাপা পড়া অথবা পুড়ে কয়লা হয়ে যাওয়া দেহগুলা মানুষ ছিল না কখনো, তারা ছিল শ্রমিক। তাদের শ্রম অতি সস্তা, তাদের রক্ত অতি সস্তা, অতি সস্তা তাদের ঘাম। সব মিলিয়ে তারা আসলে যন্ত্র। তারা বেঁচে থাকে পরের দিন বস্ত্রকারখানা মালিকদের হাতে যান্ত্রিক শ্রম তুলে দেয়ার জন্য। যার পারিশ্রমিক তারা কখনো পায় নাই, পাবেও না। সামান্য বেঁচে থাকার শর্তে  মালিকদের জন্য অনন্তকাল ধরে উদ্বৃত্ত পুঁজি তৈরি করার জন্যই তাদের জন্ম। তারা যে বস্ত্রকারখানা মালিকদের জন্য প্রত্যহ উদ্বৃত্ত পুঁজি তৈরি করছে তাও হয়তো তাদের অজ্ঞাত। তারা বিশ্বাস করে ইশ্বর নয় গার্মেন্ট মালিকরাই সামান্য কটা টাকা দিয়ে তাদের বাঁচিয়ে রাখে।

ফলে নিজেকে অনন্তশ্রমে রিক্ত করে কলের ভেতর নিজের জীবন সপে দেয়াই তাদের ইশ্বরের জন্য ইবাদত। শুধু নিজের শ্রম নয় তারা উৎপাদন করছে নিজেদের ঔরসে আরো আরো অনন্ত দাসের। জন্মের কিছুদিন পরই তারাও আবার শ্রমিক পিতামাতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে যাত্রা করবে শ্রমের গুহায়। এরা অশিক্ষিত। স্কুলে পড়ার সময় তাদের টান পড়ে ভাত-কাপড়ের। ফলে স্কুলের চেয়ে গুরুতর হয়ে দেখা দেয় তাদের কারখানার কাজ। কারণ কাজ না করলে ভাত বন্ধ। বেঁচে থাকা বন্ধ।

সকালে আর রাতে নগরীর কারখানা এলাকায় কেউ দাঁড়ালে দেখতে পাবে বন্দীশালার বন্দীদের মত কাতারে কাতারে তাদের যাওয়া আসা।দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পোল্যান্ডে আউৎসভিজ বলে একটা বন্দিশালা ছিল। যাকে বলা হতো নরক। সেখানে ছিল দানবীয় আকারের গ্যাস চুল্লি। হাজার হাজার মানুষকে যেখানে পুড়িয়ে মারা হয়েছিল। তাদের সেখানে গোসল করানোর নাম করে, কাপড় বদলানোর নাম করে ঢোকানো হতো। বন্দিদের পুড়িয়ে মারা হবে এটাই স্বাভাবিক। তাই বন্দীদের ভেতর বাঁচার আকুলতা বয়ে গেলেও গেস্টাপোদের তাতে কিছুই আসতো যেতো না।

অনুরূপভাবে বাংলাদেশের বস্ত্রকারখানাগুলা বিশেষ করে শ্রমিকরা যেখানে কাজ করে। সেসব অনেক আগেই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আউৎসভিজে পরিণত হয়েছে তা আমরা বছরের পর বছর ধরে দেখছি। প্রায়শই শ্রমিকরা পুড়ে মরছে। আগুনে তাদের হত্যা করা হচ্ছে। যে সরকার ক্ষমতায় থাকছে। তারা সেইদিন খুব শোকের ভান করছে। আস্তে আস্তে কমে যাচ্ছে শোকের আর্তনাদ। আমরা প্রায় অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছি এই নিয়মে। এখন হত্যা আমাদের কাছে তেমন গুরুতর সংবাদ না।সাভারের আউৎসভিজ এই বস্ত্রকারখানায় ১৪০জন শ্রমিককে পুড়িয়ে মারার সংবাদও কিছুদিন পর আরো ফলোআপ পাবে না। আমরা আবার বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়বো।

আমাদের আর মনে থাকবে না এই শ্রমিকেরা আগুন লাগার সংকেত পেয়ে নামতে চেয়েছিল। বাধা পেয়েছিলো কারখানা মালিকদের। কারখানা মালিকেরা তাদের সাথে প্রতারণা করেছিল। মিথ্যা বলে ঠেলে দিয়েছিল সোজা মৃত্যুকুপে। তারা বলেছিল আগুন লাগে নাই। ফের তালা লাগিয়ে দিয়েছিল। এরও আগে উপরের দিকে যেন তারা উঠতে না পারে যেখানে আগুন পৌছে নাই সেখানে তালা লাগিয়েছিল। কারখানা মালিকরূপী জল্লাদ তথা গেস্টাপোদের এরপরও কিছু হবে না। কারণ তারাই রাষ্ট্র টিকিয়ে রেখেছে। রাষ্ট্র নির্মাণ করেছে। তাদেরই অনুগ্রহ পেয়ে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিগণ বসে আছেন তাদেরকে সহযোগিতা দেয়ার জন্য।

গণমানুষতো বানের পানির মতো ইচ্ছা মতো খরচ করা যায়।প্রথাগত কারখানা মালিকদের পত্রিকার কলাম লেখকরা এরপর খুব ব্যস্ত হয়ে কারখানায় কয়টা জানলা করলে শ্রমিকরা আগুন লাগলেও নিচে লাফ দিয়ে মরতে পারবে ইত্যাদি লিখতে থাকবে। কিন্তু ষ্পষ্টতই বলা যায় এইটা হত্যাকাণ্ড। আর এই যুদ্ধের নাম শ্রেণিযুদ্ধ। এইভাবে গণহারে শ্রমিকদের মৃত্যু নাজিদের উল্লাস হয়ে আসে কারখানা মালিকদের। কারণ মানুষগুলো তাদের কাছে শোষণের যন্ত্রমাত্র।

Sunday, April 14, 2013

মনোদৈহিক আধিপত্যবাদ


দক্ষিণ এশিয়ার বিগব্রাদার ইন্ডিয়ার চলচ্চিত্রের বাজার শুধু ইন্ডিয়ায় সীমাবদ্ধ নাই। শুধু চলচ্চিত্রের বাজারই বা বলি কেন, হেন কোনো বস্তু নাই যা বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশে যায় না। আর বাংলাদেশের কথা বললেতো প্রায় প্রত্যেক নিত্য ব্যবহার্য পণ্য থেকে শুরু করে সবধরণের ভোগ্যপণ্য এখন পাশাপাশি রাখা হয়। আপনি পেয়াজ কিনতে গেলেন? এইটা বাংলা এইটা ইন্ডিয়ান। কাপড় কিনতে গেলেন এইটা বাংলা এইটা ইন্ডিয়ান। এভাবে থালাবাসন, চালডাল, আলু, লুঙ্গি, চাদর, শাড়ীসহ সমস্ত প্রসাধনের জিনিসপত্রে ঠাসা বাংলাদেশি বিপণীবিতানগুলি। বইপত্র থেকে শুরু করে প্রত্যেক বাংলাদেশি পণ্যের একটা অলটারনেটিভ ইন্ডিয়ান পণ্য আছে।

সবচাইতে বেশি যে পণ্য আমদানি হয় তা ইন্ডিয়ান সিনেমা। বম্বে, গুজরাতি, মারাঠি, কলিকাতার সিনেমায় ঠাসা দোকানগুলো তার ওপর সেটেলাইট টিভিতেতো আছে হরেক রকম ইন্ডিয়ান চেনেলের দাপট। ইন্ডিয়ার সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক নির্ণয় করতে গেলে খানিক ইতিহাসে মাথা গলাতেই হবে। অবিভক্ত ভারতের পূর্ব-পশ্চিম বঙ্গ নিয়া বিশাল ভাষাভিত্তিক বাঙালি জাতির অবস্থান ছিল একদা। পশ্চিমবঙ্গ ইংরাজদের শতবছরের রাজধানী হওয়ায় শিল্পকারখানায় পূর্ববঙ্গের চেয়ে অনেক এগিয়ে ছিল আর বিনিয়োগকর্তাদের অধিকাংশই ছিল অবাঙালি। যেহেতু পূর্ববঙ্গ শিল্পকারখানায় পিছিয়ে ছিল। তারোপর বাঙালি হলেও অধিকাংশ মানুষই ছিল মুসলমান। গান্ধী প্রমূখ মারাঠাদের একনায়কতান্ত্রিকতার ফলে জিন্নাহ প্রমুখদের দ্বিজাতিতত্ত্বের ভাগখন্ডে ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের নিরিখে পূর্ববাংলাকে পূর্বপাকিস্তান বানানো অপরিহার্য হয়ে দাঁড়ায়। এরা খানিকটা বাধ্যও ছিল কারণ খোদ পশ্চিমবঙ্গে বাঙালি হিন্দু বুর্জোয়ারা কখনোই পুর্ববঙ্গের মুসলমান বাঙালিদের তাদের সমকক্ষ হিসাবে দেখতে চায় নাই। ইংরাজদের হাত ধরে ইংরাজি কালচারের অনুকরণের মাধ্যমে নিজেদের ইংরাজ রাজের সেবক হিসাবে গড়ে তুলেছিলেন তারা। অন্যদিকে পূর্ববঙ্গবাসী অধিকাংশ মুসলমান হয়েছিল নিম্নবর্গীয় হিন্দু ও বৌদ্ধ থেকে। মুসলমান হওয়ার কারণে ও ইংরাজরা মুসলমান শাসকদের হটিয়ে ভারতবর্ষের ক্ষমতা দখল করার কারণে ইংরাজদের পক্ষ থেকে যেমন মুসলমানদের দিকে সতর্ক দৃষ্টি ছিল তেমনি মুসলমানদের পক্ষ থেকে ছিল ঘৃণা, ভয় ও অনিহা। আর সবরকমের জাতীয়তাবাদের (ধর্ম,ভাষা,অঞ্চলভিত্তিক) উদ্গাতা বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদ ছিলই।

যাইহোক, শুদ্ধ ধর্ম নিয়া যে রাষ্ট্রচালনা সম্ভব না তা অচিরেই প্রমাণিত হয়ে যায়। তা প্রথম উপলব্ধি করে শাসক পশ্চিম পাকিস্তানিরাই। রাষ্ট্র হিসাবে পশ্চিম পাকিস্তানের আদতে কোনো রাষ্ট্রচরিত্র ছিলনা, এখনো নাই। সবসময় বিদেশি সাহায্য নির্ভর এই রাষ্ট্র। ফলে উৎসমুখ হিসাবে তাকে নির্ভর বা তৈরি করে নিতে হয় পূর্ব পাকিস্তানকেই। পূর্বপাকিস্তানকে একটা কলোনি ছাড়া অন্য কিছু ভাবতে পারতো না তারা। পূর্বপাকিস্তানের উপর নির্ভর করেই পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনৈতিক বুনিয়াদ তৈরি করাই ছিল তাদের উদ্দেশ্য কিন্তু সাংস্কৃতিক নৈতিকতার কথা বললে জাতি হিসাবে পাকিস্তানি আর বাংলার মানুষের সাংস্কৃতিক বিকাশ এক ছিলনা। ফলে সাংস্কৃতিক ফারাক থেকে যে বিচ্ছিন্নতার সম্ভাবনা দেখা দিল তার সুযোগ নিল ভারত। বাংলাদেশ পাকিস্তানের অর্থনৈতিক উপনিবেশ থেকে পরিণত হল ভারতের মননের উপনিবেশে।

এই অসাধ্য সাধন হয়েছিল সাংস্কৃতিগতভাবে বাংলারমানুষ ভারতের সাথে জড়িত ছিল সুদীর্ঘ কাল থেকে। কারণ বাংলার অর্ধেক তো সবসময় ভারতের ভেতর। কিন্তু এই বাংলার অধিবাসীদের ভাষা বাংলা হলেও তারা যে অধিকাংশ মুসলমান সে কথাও ভারতের খেয়াল আছে। কিন্তু ভারতের সমস্যা অন্যজায়গায়। ভারতরাষ্ট্র বহুজাতিক রাষ্ট্র। বহু ভাষাভাষি যুক্তরাষ্ট্র। এক সাথে ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটলে ভারত ছত্রভঙ্গ হয়ে যাবে। হিন্দিকে সবভাষাভাষিদের ওপর চাপিয়ে দেয়ার আগে তাই ভারতকে অগ্নিপরীক্ষা দিতে হয়েছে, এখনো হচ্ছে। সেই অগ্নিপরীক্ষার পুলসেরাত হচ্ছে বলিউড বা ভারতের চলচ্চিত্র কারখানা। যেমন আমেরিকার হচ্ছে হলিউড পর্নইন্ডাস্ট্রি।

রাষ্ট্রের শ্রেণিচরিত্র হিসাবে ভারত আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে মিল অনেক দিক দিয়ে। প্রথম মিল হচ্ছে দুইটি দেশই বহুভাষা, বহুসংস্কৃতির মিশেল। কিন্তু এই বহুসংস্কৃতিকে বহুভাষাকে একসুতায় গাঁততে না পারলে রাষ্ট্র হিসাবে টিকে না থাকার সম্ভাবনা তৈরি হয়ে যায়। আর তাই ভাষার সাম্রাজ্যবাদি চেহারা দেখা যায় বিশ্বের তিনটা ভাষায়। চায়নিজ মেন্দারিন, ইংরাজি আর হিন্দি। ইউনেস্কো স্ট্যাটাসটিক্যাল ইয়ারবুক (১৯৯৬) অনুযায়ী দেখা যায়। এই তিনটা ভাষা মাতৃভাষাভাষির চেয়ে ব্যবহারিক দিক দিকে এগিয়ে। চায়নিজ মেন্দারিন ৮০ কোটি লোকের মাতৃভাষা কিন্তু এই ভাষায় কথা বলে ১০০ কোটি মানুষ। ইংরাজি ৩৫ কোটি মানুষের মাতৃভাষা কিন্তু এই ভাষায় কথা বলে ১৯০ কোটি মানুষ। হিন্দি ৩৫ কোটি মানুষের মাতৃভাষা কিন্তু এই ভাষায় কথা বলে ৫৫ কোটি মানুষ। এই চিত্র অনেক আগের তা এখন বেড়ে নিশ্চয়ই দিগুণ হয়েছে। ভারতের অভ্যান্তরীণ ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদকে দাবিয়ে রাখার জন্য খুবই প্রয়োজন ছিল বলিউড সিনেমা কারখানা। ভারতের প্রত্যেক প্রদেশের মানুষ এখন একাধিক ভাষায় কথা বলে। নিজের প্রাদেশিক ভাষা (মাতৃভাষা), হিন্দি ভাষা ও ইংরাজি ভাষা (কোনোকোনো ক্ষেত্রে ব্যতিক্রমও আছে)। এক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গ অন্যান্য রাজ্য থেকে একধাপ এগিয়ে। কারণ পশ্চিমবঙ্গ একসময় বৃটিশভারতের রাজধানী ছিল। ফলে ইংরাজিটা অনেক আগে থেকেই কলকাতায় থিতু। হিন্দিটা এখন ক্রমে থিতু হচ্ছে। হিন্দু থিতু হওয়ার পেছনে আগেই বলেছি রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ততো ছিলই তার বাস্তবায়নে সবচাইতে ভূমিকা রেখেছে বলিউড ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি। বলিউডের এই সম্ভাবনা দেখে অনেক আগেই রাষ্ট্রীয়ভাবে এটাকে ইন্ডাস্ট্রি বা শিল্প কারখানা হিসাবে ঘোষণা করা হয়েছে। সেই ইন্ডাস্ট্রি এখন গোটা উপমহাদেশ নিয়ন্ত্রণ করে। 

রাশিয়ায় যখন প্রথম চলচ্চিত্র প্রদর্শন করা হল, ম্যাক্সিম গোর্কি ছিলেন দ্বিধান্বিত। লুমিয়র ভাইদের বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারকে স্বীকার করে নিয়েও তিনি বলেছিলেন ‘শেষ পর্যন্ত মানবজীবন ও মনের উন্নতিতে এই নব আবিষ্কার ব্যবহৃত হবে কিনা, লুমিয়রদের ট্রেনের ছবি, পারিবারিক ছবি শীঘ্রই বুর্জোয়াদের  নগ্ন থাবায় স্থলাভিষিক্ত হবে, তখন ছবিগুলোর নাম হবে ‘যে নারী নগ্ন হচ্ছে,  ‘স্নানঘরে মহিলা, ইত্যাদি। হয়েছেও তাই। সবদেশেই বুর্জোয়াদের চেহারা প্রায় আন্তর্জাতিক। তারা মত্ত সস্তা বিনোদনে। তাদের অন্যতম বিনোদন হচ্ছে যৌনতা। যৌনতা বিনোদন পরিণত হয়েছে এখনকার সবচাইতে লাভজনক ব্যবসায়। হলিউডি বুর্জোয়ারা যৌনফিল্ম উৎপাদন করে কোনো রাখঢাক ছাড়াই তারা যার নাম দিয়েছে পর্ণইন্ডাস্ট্রি। কিন্তু বলিউডি বুর্জোয়ারা খায়েস থাকা সত্বেও সরাসরি পর্ণইন্ডাস্ট্রিতে পরিণত করতে না পারলেও তাদের প্রকাশভঙ্গি আরো মারাত্মক। যদিও বলিউডে বেশির ভাগ ছবিই পর্ণছবি। কিন্তু তারা এইটার সামাজিকীকরণ ঘটাচ্ছে। খানিকটা সমাজের ভয়ে তারা সরাসরি আগাইতে পারছেনা কারণ ভারতে বহুমানুষ এখনো দারিদ্র্যসীমার নীচে বাস করে। সামন্তীয়রা এখনো ঘাপটি মেরে আছে সমাজের রন্দ্রে তাদের ধর্মকর্মসহ। আর রাষ্ট্রের ব্যাপক অংশ শোষিত জনগণ যারা এখনো বেঁচে আছে তাদের আফিমের (ধর্ম) ওপর ভর করে। আবার এই জনগণই বলিউডি এই আধাপর্ণ সিনেমা বাঁচিয়ে রাখার শক্তি। যদিও বলিউডি সিনেমায় সাধারণ জনগণের কোনো স্থান নাই। সিনেমায় তারা প্রায় চোর বাটপার, কালোবাজারী। বলিউডি কাহিনীগুলা পাতিবুর্জোয়াদের বুর্জোয়ায় পরিণত হবার খায়েস। বুর্জোয়াদের প্রেমবিলাস তথা শৃঙ্গার তথা কামবিলাসই হিন্দি সিনেমার মূলস্রোত। সেটা বলিউডের সিনেমাগুলা দেখলেই বুঝা যায়। আর এখনতো সিনেমার কাহিনীর ভেতরে অধিকাংশ নায়িকাই বিদেশ থেকে লেখাপড়া করে আসে তারা স্বল্পবসনা, তথাকথিত আধুনিক, যৌনউন্মত্ত এবং বুর্জোয়া পরিবারের। শিক্ষাদীক্ষা শেষে তারা ভারতে আসে তাদের সাথে পরিচয় হয় পেটিবুর্জোয়া বা কোনো লুম্পেন প্রলেতারিয়েতের যার জীবনবাসনা বুর্জোয়া হবার। এরপর বুর্জোয়ার প্রতিরোধের চেষ্টা। অগ্নি পরীক্ষা শেষে তাকে গ্রহণ করে বুর্জোয়া পরিবার। এর মধ্যদিয়ে অধিকাংশ সময় দেখানো হয় বুর্জোয়া মেয়েটার দেহবাসনা। এরমধ্যে আরেকটা শ্রেণিচরিত্র কাজ করে। বলিউডি যে কোনো শ্রেণির নারীই যৌনখাদ্য হিসাবে ব্যবহৃত হয়। যাইহোক বাস্তবেও তাই বলিউডের প্রায় নায়িকারাই এখন বুর্জোয়া পরিবার থেকে আসা। সবাই প্রায় বিদেশের বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বা বিলাতের স্কুল কলেজে পড়া। প্রিয়াংকা চোপড়া, আমিশা পেটেল, ক্যাটরিনা কাইফসহ অনেকেই আছে। 

 সাম্প্রতিক বলিউডি সিনেমায় ‘আইটেম সং’ বলে একটা জিনিস চালু হয়েছে। এটা যৌনতাকে সামাজীকিরণের আরেকটি ধাপ। নায়িকাদের যে যৌন আচরণ এখনো পর্যন্ত কাহিনীর ভেতর দিয়া দেখানো সম্ভব না তা এই আইটেম সংয়ের মধ্য দিয়ে দেখানো হচ্ছে। সম্প্রতি আইটেম সংগুলা  গোটা সিনেমাকেই হিট করিয়ে দেবার যোগ্যতার প্রমাণও দিয়েছে। এইরকমই তিনটা আইটেম সং হচ্ছে, শিলা কি জওয়ানি, মুন্নি বদনাম হুয়ি, উলালা উলালা। গানগুলা যথাক্রম তিসমারখান, দাবাং ও ডার্টি পিকসার সিনেমার। গান তিনটার কথাগুলা খেয়াল করে শুনলে একটা জিনিস পাওয়া যায়। তিনটারই ভাবার্থ প্রায় অভিন্ন। গানগুলাতে যথাক্রমে ঠোঁট মিলিয়েছেন ক্যাথরিনা কাইফ, মালাইকা অরোরা, ও বিদ্যা বালান। তিনজনই শিক্ষিত সুন্দরী যৌবনবতী ও বুর্জোয়া পরিবার থেকে আসা। তিনটা গানেই যথেষ্ট দেহঝড় তুলেছেন তিনজনেই। তিনটা গানের কথাগুলাই খেয়াল করলে দেখা যাবে খদ্দেরদের সাথে যৌনকর্মীরা যে ধরনের কথা বলে বা দরদাম ঠিক করে প্রায় তার কাছাকাছি। টাকা নিয়া আসো এই ঢেকে রাখা যৌবন উপভোগ করো। 

 যে ধরনের ইনস্ট্রোমেন্ট ব্যবহার করা হয়েছে । যে ধরনের উত্তেজক সুরে গানগুলা বাধা হয়েছে। তাতে একবছর ধরে গোটা উপমহাদেশে ও ভারতীয় চ্যানেলগুলাতে যেগুলা উপমহাদেশের প্রায় প্রতিটি ঘরে ঘরেই প্রতিনিয়ত বেজে চলেছে। বাংলাদেশেও যে কোনো বিয়া বা মেহেদি অনুষ্ঠানে। দূর পাল্লার কোনো গাড়ীতে। যে কোনো অনুষ্ঠানেই বেজে চলেছে এই গানগুলা। স্কুল কলেজে পড়ুয়া ছাত্রছাত্রীরা কানের মধ্যে মোবাইলের হেডফোন লাগিয়ে নিয়ত শুনছে এই গানগুলা। মোবাইলে ছোট স্ক্রীনে ফাকে ফাকে দেখেও নিচ্ছে। জীবনের, দৈনন্দিনের একটা বিশাল সময়জুড়ে তারা প্রায় নিজেদের অজান্তেই এই চর্চা করে যাচ্ছে অবিরাম।

 এইগানগুলা ঠিক কি ধরনের প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করবে’র চাইতেও বড় প্রশ্ন হচ্ছে এই ভারতীয় সিনেমা, গান, সিরিয়াল, বিজ্ঞাপন, সাহিত্য ইত্যাদি মিলিয়ে রাষ্ট্র হিসাবে ভারতের আধিপত্যকে প্রশ্নহীন মেনে নেয়ার ব্যাপারে মননের ক্ষেত্র তৈরি করবে। একটা ভারতীয় সেভের লোশন শুধু লোশন না এইখানে মিশে থাকে সালমান, শাহরুখ, অক্ষয় কুমারের বিজ্ঞাপনি যাদু ও তাদের গ্রহণযোগ্যতা। একটা শ্যাম্পু বা ফেসওয়াস বা ক্রীম শুধু ক্রীম নয় তাতে মিশে থাকে কারিনা কাপুর, ক্যাথরিনা কাইফ, প্রিয়াংকা চোপড়ার গ্রহণযোগ্যতা। এগুলা প্রায় ভোক্তার নিজের অজান্তেই তার মনে গ্রহণযোগ্যতা বা আবেদন তৈরি করে রাখে সম্প্রসারণবাদী ভারতকে, তার আধিপত্যকে গ্রহণ করার ব্যাপারে। ঈদের মার্কেটে মেয়েদের পোশাকের নাম হয় শিলা, মুন্নি ইত্যাদি।

সম্প্রতি ভারতীয় সিনেমাগুলা বাংলাদেশে আমদানি শুরু হয়েছে। বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রেক্ষাগৃহে এখনো যেগুলা টিকে আছে। তাতে দেখানো হচ্ছে। যদিও এখনো কলকাতার বাংলা ছবি দেখানো হচ্ছে। কিন্তু ক্রমে পুরানা হিন্দি ছবি ইত্যাদি দেখানোর মাধ্যমে একদম টাটকা মুক্তিপাওয়া সিনেমাও দেখানো হবে। সিনেপ্লেক্সগুলাতে। যদিও সিনেমা হল পর্যন্ত টাটকা সিনেমাগুলা দৌড়ে না আসার কারণ হচ্ছে এমনিতে ডিভিডি, সিডি, টিভি চেনেল দিয়া তারা সেই চাহিদা পুরণ করেছে। 

বাংলাদেশে বইয়ের দোকানগুলা পর্যন্ত ভারতীয় সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের শিকার। বইয়ের লাভজনক ব্যবসা মানে ইন্ডিয়ান বইয়ের ব্যবসা। নিয়মিত যারা শাহবাগের আজিজ মার্কেটের বইয়ের দোকানে যায় তারা জানেন ইন্ডিয়ান বাংলা-ইংরাজি বইয়ের ভীড়ে বাংলাদেশি বইগুলাকে কেমন শীর্ণ দেখায়। সেল্ফের অপেক্ষাকৃত অনালোকিত স্থান হয় তাদের জন্য বরাদ্দ। এখানে বলা অসমীচিন হবে না। আমার প্রবন্ধের বই ‘রাজ্য ও সাম্রাজ্য'র পাঁচটা কপি আজিজ মার্কেটের ‘তক্ষশীলা’ নামের একটা দোকানে বিক্রি করার উদ্দেশ্যে দিয়েছিলাম। আমার সামনেই একটা কপি সেল্ফের বেশ ভাল জায়গায় রাখল। দু’দিন পর পরিচিত একপাঠক যাকে আমি জানিয়েছিলাম বইটা এই দোকানে পাওয়া যায়। সে বইটা খুঁজে না পেয়ে আমাকে ফোন দেয়। কিছুদিন পর গিয়ে দেখি ইন্ডিয়ান বইয়ের জন্য দোকানে ঢুকা প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেল্ফে না দেখে জিজ্ঞেস করলে দোকানের মালিক বেশ বিরক্ত হয়ে বলল, দেখছেন না বই আসছে, কলকাতার বই রাখার জায়গা নাই? একজন লেখক হিসাবে খুবই অপমানজনক অবস্থা। আমি বললাম, আমার বইগুলা আমারে দিয়ে দেন। দোকানি বলল, পরে আইসেন বই নীচে পড়ে গেছে। সন্দেহ করলাম আমার বইগুলা ভাগ্য হয়েছে কলকাতার বইগুলার রক্ষাকবচ হিসাবে, বইগুলার নীচে মেঝেতে। সত্যিকার অর্থেই একদিন অনেক বইয়ের নীচে একেবারে মেঝে থেকে তিনটা বই টেনে বার করলো। ততক্ষণে বইগুলা চেপ্টা হয়ে গেছে প্রায়। এই অভিজ্ঞতা অনেকেরই থাকার কথা।

অবিভক্ত বাংলা হিসাবে মানুষ ইংরাজ আমল থেকেই এদেশেও কলকাতার সাহিত্য পড়েছে।কিন্তু তাও খানিকটা শুদ্রের চোখে ব্রাক্ষ্মণ‌্য সাহিত্য পড়বার মতই। আর কলকাতায় বিষয়টাতো গড়ে উঠেছে একইরকমভাবে, অনেক আগেই। খুব সম্প্রতি অনেকের এরকম অভিজ্ঞতাও হয়েছে যে, কলকাতার জনপ্রিয় কবি সাহিত‌্যিকদের যদি জিজ্ঞেস করা হয়, বাংলাদেশের কাদের লেখা পড়েন? সেক্ষেত্র পাল্টা প্রশ্ন শুনতে পাবেন, ওখানে কারা লিখছে, দুএকটা নাম বলেন? বাংলাদেশ রাষ্ট্র হিসাবে আলাদা ভুখণ্ড পাবার পরও আলাদা কোনো সাহিত্যিক পরিচয় এখনো আমরা অর্জন করতে পারি নাই সেটাও 'প্রভাব' ও 'অবনত গ্রহণে'র কারনে। 

 সেই একাত্তরের পর থেকে। দেশ স্বাধীন হবার পরও এখন অব্দি বাংলাদেশের সাহিত্য, চিন্তা সবই প্রায় কলকাতা নির্ভর। এখনও কলকাতার কবি, সাহিত্যিক, সমালোচকদের মত’ই আমাদের কাছে শ্রেষ্ট। তাদের সনদ না পেলে যেনো এদেশে কবি,সাহিত্যিক হওয়া যায় না। চিন্তা করা যায় না। সেই শামসুর রাহমান থেকে শুরু করে অনেকেই এখনোব্দি কলকাতায় হাজিরা দিয়ে যাচ্ছে ও কলকাতার কবি সাহিত্যিকদের বাংলাদেশে এনে নিয়মিত পায়ের ধূলা ও উপদেশ নিচ্ছে। বিদেশি সাহিত্য আমাদের পড়তে হবে। কলকাতার সব লেখক তৃতীয় শ্রেণির তা বলাও আমার উদ্দেশ্য নয়। ভাল লেখকদের কখনো ডাকি না আমরা ডেকে আনি তৃতীয় শ্রেণির লেখকদের। মুন্নির জওয়ানি, শিলার বদনামির মতই তাদের লেখাজোকা নিজেদের অজান্তে আমাদের মননের ক্ষেত্র তৈরি করে তাদের মত করে, রাষ্ট্র হিসাবে প্রশ্নহীন ভারতীয় আধিপত্য মেনে নেয়ার ব্যাপারে।

লিমন প্রশ্নে রাষ্ট্র অথবা অকার্যকর রাষ্ট্রের শিরা উপশিরা



লিমন নামের এক কিশোরের পায়ে গুলি করেছিল র‌্যাব নামের আইন প্রয়োগ বাহিনীর সদস্যরা। যদিও লিমনের পক্ষে এই দুর্বল অভিযোগ এই রাষ্ট্রের নাগরিক হিসাবে বিশ্বাস করতে এখনো আমাদের ভয় হয়। তারচেয়ে পুলিশ র‌্যাবের অভিযোগ লিমন সন্ত্রাসী, র‌্যাবকে হামলা করতে গিয়ে তার পা হারাতে হয়েছে, সর্বপরি পঙ্গু ছেলেটির উপর হামলা, তার নামে অস্ত্র মামলা দেয়া ইত্যাদি বিশ্বাস ও সমর্থন পলাতক নাগরীক হিসাবে আমাদের জন্য নিরাপদ। অনেক দিন ধরে লিমন খবরের কাগজের শিরোনাম হচ্ছে। এটা জাতি হিসাবে আমাদের জন্য বড় অস্বস্থিকর। অনেক দিন ধরেই মনে হচ্ছে একদিকে লিমন অন্যদিকে একটি রাষ্ট্র এই সামান্য বিষয় নিয়া অনেক বেশি তর্ক শুরু করেছে। র‌্যাব পুলিশ আইন আদালত রাষ্ট্রের এই স্তম্ভটির বিরুদ্ধে কিসের শক্তিতে এরকম এক ক্ষুদ্র দুর্বল পরিবার অনমনীয়ভাবে লড়াই করার চেষ্টা চালাচ্ছে? তা চিন্তা করতে সক্ষম মানুষমাত্রকেই ইতিমধ্যে ভাবিয়ে তুলেছে। এ নিয়া হাছামিছা অনেক কথাবার্তা চালু হয়েছে বাজারে।

মেকিয়াভেলিয়ানরা ইতিমধ্যেই স্রেফ এই ব্যাপারটা নিয়া রাষ্ট্র হিসাবে বাংলাদেশ কার্যকর কিনা সেই প্রশ্ন তুলবেন। এত ক্ষুদ্র একটা বিষয় নিয়া যেদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে এতদিন ধরে ব্যস্ত তটস্থ থাকতে হয় সেই দেশে আদৌ কোনো আইন আছে কিনা সেই সন্দেহও তারা করবেন। বিশেষ করে যে দেশে ক্রসফায়ারের মত বিষয়ও নিরন্তর জারি আছে। তাকে ঢেকে রাখার জন্য যে দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাফাই গায় সেরম একটা রাষ্ট্রে এটা অকল্পনীয় বৈকি! রাষ্ট্র হিসাবে বাংলাদেশের শ্রেণিচরিত্র আন্দাজ করতে হলে খানিকটা ইতিহাসের পায়ে ভর করে পেছন দিকে হাটতে হবে। খুব বেশিদূর যাবো না। কারণ ইতিহাস একটা না-গাথা অকল্পনীয় মালার মত যা কেবল সূত্র উৎপাদন করতে থাকবে।

আমি স্রেফ একাত্তর পর্যন্ত ফিরে দেখতে চাই। তাইলে দেখা যায় একাত্তরে বিপ্লব সফল হয় নাই, প্রতি বিপ্লব সফল হয়েছে। অর্থাৎ  অস্ত্রহীন সহায়হীন নিস্বম্বল গণমানুষ পাকিস্তানি জান্তার সমস্ত বুলেট, শিশ্নের প্রহার, দেশিয় দালালদের লোলুপতাকে কেবল আত্মবিশ্বাসের উপর ভর করে কাধে ঠেলে পার করেছিলেন। সাথে যুক্ত হয়েছিল ভারতিয় স্বার্থ। সন্দেহ হয় সেই গণমানুষও সচেতন ছিলেন কিনা তাদের স্বাধীনতা বিষয়ে। অথবা স্বাধীনতা বলতে ঠিক কি বুঝায় তা তারা অনুধাবন করেছিলেন কিনা। অথচ সেই বিজয়ও তাদের থাকে নাই। পরবর্তীকালে গ্রেপ্তার হয়ে যায়। এমন কিছু মানুষ ক্ষমতাকে হাইজেক করেছিলেন যারা নয়মাস যুদ্ধকালীন সময়ে মাঠেই ছিলেন না বলতে গেলে ফলে ‘র’ বা ‘সিআইয়ে’র হাতে দেশের মরা অর্থনীতিকে সমর্পন করতে তাদের হাত কুণ্ঠিত হয় নাই। 

একাত্তরের দার্শনিক ভিত্তি এতই নড়বড়ে ছিল যে পাকিস্তানি শাসকদের দেশিয় দোসর বুর্জোয়ারা, রাজাকাররাও পরবর্তীতে মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে সার্টিফিকেট ইত্যাদি কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে একাকার হয়ে গেছিলেন শাসক গোষ্ঠীর সাথে। অবশ্য সেই সময়ের ভারত পলাতক দেশপ্রেমিক পেটিরা আর রাজাকারদের মধ্যে তেমন তফাৎ ছিল না। ফলে যে সব সাধারণের পুরা পরিবারই নিকেশ হয়েছিল নয়মাস ব্যাপী যুদ্ধে তারা ফের মাঠে ফিরে গিয়েছিলেন নিজের দেহটাকে খাদ্য দিয়ে বাঁচিয়ে রাখার উসিলায়। বলতে চাই গণমানুষ যেই তিমিরে ছিলেন সেই তিমিরেই রয়ে গেলেন। শাসক শ্রেণির নিজস্ব আইন প্রয়োগ বাহিনীর সাথে পাকিস্তানি আর্মি বা আইন প্রয়োগ বাহিনীর বিশেষ কোনো পার্থক্য থাকে নাই। জনগণের সাথে পাকিস্তানি আইন প্রয়োগ বাহিনীর যেইরকম সম্পর্ক ছিল স্বাধীন দেশের শাসক শ্রেণির আইন প্রয়োগ বাহিনী তার ব্যতিক্রম নয়।

শেখ মুজিব তো নিজস্ব একাধিক বাহিনীই গঠন করেছিলেন। শুধু বাহিনীই নয় প্রথম সফল ক্রসফায়ারের জনকও ছিলেন তিনি। সিরাজ শিকদার ছিলেন বাংলাদেশে ক্রসফায়ারের প্রথম শহিদ। তার হত্যার পরও এখন প্রতিটি ক্রসফায়ারের শেষে মিডিয়ায় যেই কল্পিত পাল্টা হামলার গল্প ফাঁদা হয়, সে রকম বলা হয়েছিল। ফলে কাউন্টার হিসাবে এরপর যারা ক্ষমতায় এসেছে রাষ্ট্রীয় বাহিনীকে তারা নিজের বাহিনী হিসাবেই ভেবেছিলেন। সেভাবেই গড়ে নিয়েছিলেন তাদের। এখনও তা আমরা দেখতে পাই। সরকার গঠন করার প্রথম পদক্ষেপ হিসাবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রধান থেকে শুরু করে বাহিনীতে, সচিবালয়ে, উর্ধ্বতন পদগুলাতে নিজস্ব লোক ঢোকানোর এক তীব্র প্রতিযোগিতা। ফলে রাষ্ট্রের কোনো স্থায়ী চরিত্র কখনোই পায় নাই বাংলাদেশ। বাংলাদেশে প্রায় প্রতিটি শাসক বাহিনীই বাংলাদেশকে 'আমার বাংলাদেশ' হিসাবেই ভেবেছেন।   আমার পিতা বা আমার স্বামীর বাংলাদেশ হিসাবে ভেবেছিলেন। জনগণের বাংলাদেশ নয়।

এসব পানসে জাতীয়তাবাদ শিশু বা বুড়াকে জোর করে ঔষুধ খাওয়ানোর মত প্রায়। উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত খানিকটা পৈত্রিক তালুকের মতই এদেশে রাজনীতিও প্রবাহিত হয়ে আসছে। ফলে এহেন হাইজেক স্বাধীনতা থেকে জনগণ যে নামমাত্র মুনাফাও তুলতে পারে নাই তার বড় প্রমাণ আজ বরিশালের পা কাটা লিমন।যেন সেই যুদ্ধ এখনো শেষ হয় নাই। এখনো হানাদার বাংলাদেশের সাধারণ মানুষদের গুম করে ফেলছে, হত্যা করছে, যত্রতত্র গুলি করে সন্ত্রাসী বলে চালাচ্ছে। রাস্তা থেকে তুলে নিয়া নিরপরাধ কিশোরী তরুণীদের গণধর্ষণ করে ক্ষতবিক্ষত লাশ ফেলে দিচ্ছে। আগে তাদের উপর এই ধরনের অত্যাচার চালানো হতো মুক্তিবাহিনী বলে। যেন ক্ষমতার মসনদে সেই বিদেশিরাই বসে আসে। আসলেও তাই বাংলাদেশ মানে এই অঞ্চল সবসময় শাসিত হয়েছে বিদেশিদের দ্বারা। আর্য, মোগল, ইংরাজ, পাকিস্তানি।

একাত্তরের পর থেকে যারা বাংলাদেশের ক্ষমতাকেন্দ্রে আছে তারাও মননে বিদেশি, যতই জাতীয়তাবাদের জিগির তুলুক না কেন। আমলা থেকে পাতি নেতা পর্যন্ত সবারই সামান্য সর্দিজ্বর হলে সিঙ্গাপুর চলে যায়। এদের সন্তান লেখাপড়া করে বিলাতসহ ইউরোপ আমেরিকায়। এরা অবকাশ যাপন করে ব্যাংককে, সিঙ্গাপুর, সুইজারল্যান্ডে। আবার অবসর নেয়ার সাথে সাথে তারা অভিবাসী হয়ে চলে যায় বিদেশে। খোদ শেখ হাসিনার সন্তান পাকাপাকিভাবে থাকেন আমেরিকায়। বোনেরা থাকেন ইংলন্ডে। খালেদা জিয়ার সন্তানাদিও তাই। দেশগুলাতে জনগণের জানমালের নিরাপত্তার বুর্জোয়া নীতিবাদেও তাদের বিশ্বাস নাই। বাংলাদেশের শাসক শ্রেণির চরিত্র লুণ্ঠনকারীর মতই। এই দেশটা আসলেই তাদের লুণ্ঠনের ক্ষেতে পরিণত হয়েছে। এই জন্য রাষ্ট্রটা খানিকটা আধা সামন্তীয় চেহারায় জনগণের সামনে খাড়া হয়। বলাই বাহুল্য বাকী অর্ধেক বুর্জোয়াদের। 

লিমন বা তার পরিবার একটা সিম্বল। বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় বাহিনীর হাতে অসহায় শত শত পরিবারের একটি। এই পরিবারও হয়তো জানে যে কোনো মুহূর্তে গোটা পরিবারটাকেই নিকেশ করে দিতে পারে। অজস্র খুনের কোনো আগামাথা পাওয়া যায়না যেই দেশে সেখানে এটা খুবই স্বাভাবিক। তবুও তারা ন্যায় বিচার প্রত্যাশা করছে সমাজ ও রাষ্ট্রের কাছে। শত শত পরিবার জানে তাদের অবস্থাও এরচেয়ে ভাল নয়। তবুও তারা লিমন বা তার পরিবারের পক্ষে দাড়াচ্ছে না। দাড়াবে না। কারণ তারা বাধা রাজনৈতিক রজ্জুতে। রাজনৈতিক বা অরাজনৈতিক প্রতিবন্ধকতার কারণে রাষ্ট্রের শিকার হওয়া মানুষ যখন কোনো ভাবেই প্রতিকার পেতে ব্যর্থ হয় হয়ত তাকেই বলে ফেসিজম। এই ফেসিজম শুধু সরকারের এজেন্ডা থাকেনা। যার প্রভাব জনগণের চরিত্রেও পরিলক্ষিত হয়। যেমন আমরা ইদানিং দেখছি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মদদে জনগণ ডাকাত সন্দেহে নির্মমভাবে পিটিয়ে মারছে জনগণকে। যেমন আমিন বাজারের বড়দেশি গ্রামে ছয় ছাত্রকে পুলিশের উপস্থিতে গ্রামবাসীরা নির্মমভাবে পিটিয়ে মারলো। নোয়াখালীতে এক নিরপরাধ কিশোরকে পাগলা কুকুরের মত পিটিয়ে মারলো জনগণ। এরও উস্কানিদাতা ছিল পুলিশ বাহিনী।

বাংলাদেশের থানাগুলার কথাই ধরা যাক। হরর সিনেমার মত লাগে। অভিযোগ দিতে গেলে টাকা। সার্জসিট দিতে গেলে টাকা। জিডি করতে গেলে টাকা। আসামী ধরাইতে গেলে টাকা। যে আসামী পুলিশের হাত থেকে বাঁচতে গেলেও টাকা। আবার আসামী পক্ষের টাকার জোরে রাতারাতি বদলে যাচ্ছে মামলার ধরণ। তাহলে তথাকথিত রাষ্ট্রীয় ন্যায় বিচারের ধারণাটা এখানে কি দাড়াচ্ছে? এবং এই ফেসিজম অকার্যকর রাষ্ট্রের আরেকটি উৎকৃষ্ট উদাহারণ। বাংলাদেশের জনগণ শাসকশ্রেণির নির্ভরতার জায়গা নয়। শাসন বা শোষনের জায়গা। তাদের নির্ভরতার জায়গা হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত। ফলে মার্কিনি ও ভারতিয় পলিসির লগে নিজেদের খাপ খাওয়াতে তারা যত ব্যস্ত সময় কাটায় তার কিয়দাংশও জনগণের জন্য ব্যয় করে না। এইটা হচ্ছে অকার্যকর রাষ্ট্রের অন্যতম লক্ষণ। অন্যদিকে নিত্যপণ্যের দাম বিদ্যুৎ আইন ব্যবস্থায় সরকারের কোনো আগ্রহ না থাকায় দেশে নিত্য গৃহযুদ্ধের পরিস্থিতি বিরাজমান। সরকার প্রধানদের তথাকথিত আশাবাদ ও উন্নয়ন বিষয়ক মিথ্যাচার বাদ দিলে শাদা চোখে আমরা দেখতে পাই এক নিরব দুর্ভিক্ষ বয়ে বেড়াচ্ছে পুরা জাতির নিম্নবিত্ত ও নিম্মমধ্যবিত্তরা।

তরি তরকারি ফলমুল মাছমাংসে ফরমালিন আজ সতসিদ্ধ বিষয়। গণহারে মানুষ বাজার সিন্ডিকেটের বলি হচ্ছে নিয়ত। কেনসার খুব দ্রুত মহামারি আকার ধারণ করবে বলে মনে হচ্ছে দেশে। অন্যদিকে বাড়ছে ঔষুধের কোম্পানি। কারণ ঔষুধ কোম্পানির পোয়াবারো মানেই মানুষের সর্বনাশ। চিকিৎসা ব্যবস্থা এখন ডাক্তার আর ঔষুধ কোম্পানী যৌথ ব্যবসা। খাদ্য বিষক্রিয়ার যেন এক নিরব গণহত্যাই সংগঠিত হতে চলেছে দেশে।অন্যদিকে দেশকে ভেতর থেকে কুরে খাচ্ছে মেকনামারার এনজিওগুলা। নানান এজেন্ডায় নানান কিসিমের রূপ ধরে তারা বিভ্রান্ত করছে মানুষকে। সুদখোর ইউনুসের মত একজন এনজিও কর্মীও একটা রাষ্ট্রের চেয়ে ক্ষমতাবান। এসবই অকার্যকর রাষ্ট্রের শিরা উপশিরা।

মেকনামারার এনজিও পলিসির পেছনে ছিল আসলে রাষ্ট্রকে অকার্যকর রাষ্ট্রে পরিণত করার কৌশল। সরকারের সব কাজ নিয়াই আসলে সওদা করে এনজিও গুলা। রাষ্ট্রের ভেতর থেকে সরকারকে সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হতে না দেওয়াও তাদের অন্যতম এজেন্ডা। দেখা যাচ্ছে বৃহৎ জনগণের কাছে সরকারের কাজ সাম্রাজ্যবাদিদের লাঠিয়ালের মত। বলা হয়ে থাকে দুনিয়ার তাবৎ সেনাবাহিনীই মার্কিন সেনাবাহিনী। দুনিয়ার এমন রাষ্ট্র নাই যেখানে মার্কিন সেনাবাহিনী নাই। যেখানে স্বমূর্তি রূপে তারা নাই সেখানে তৃতীয় বিশ্বের সেনাবাহিনী থেকে নিয়েই এমন বাহিনী তারা গঠন করে যাকে মার্কিন সেনাবাহিনী হিসাবেই গণ্য করা হয়। তাদের বেতনভাতা সবই মার্কিন বহন করে।বিশেষ করে ভিয়েতনামে পরাজয়ের পর তৃতীয় বিশ্বে সাম্রাজ্যবাদের আগ্রাসনের পলিসি বিস্তর পরিবর্তিত হয়েছে।

এখন হানাদার অন্যদেশ থেকে আক্রমণ করে না। তাদেরকে স্বজাতির ভেতর থেকেই তৈরি করা হয়। এরা আমাদেরই ভাই বেরাদর এলাকাবাসী। একেকটা বাহিনীতে যোগ দেয়ার পর তাকে অন্ধ করে দেয়া হয়। তার কাজ হচ্ছে মানুষ হত্যা। মানুষের সাথে প্রতারণা করা। অর্থাৎ সিস্টেম তাকে চালনা করে নিজস্ব সফটওয়ারে। তাকে বলা হয় এই তার চাকুরি। অ্যাডওয়ার্ড সাঈদ এক সাক্ষাৎকারে সাক্ষ্য দিয়েছিলেন। তিনি নিজেই সাক্ষাৎকার গ্রহণ করছিলেন এক মার্কিন সেনার। সাঈদ সাহেব মার্কিন সেনাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, তিনি সেনাবাহিনীতে ঠিক কোন কাজটি করেন? জবাবে মার্কিন সেনা বলেছিলেন, তিনি বিমান নিয়া যুদ্ধক্ষেত্রে রাষ্ট্র প্রদত্ত টার্গেট পুর্ণ করেন। তার মানে কি আর খুলে বলতে হবে? তার মানে রাষ্ট্র তাকে যেই পরিমাণ মানুষ হত্যা করতে বলেছে সেইপরিমাণ মানুষ হত্যার চেষ্টা চালান তিনি। এইটা স্রেফ একটা চাকুরী হিসাবেই দেখা হচ্ছে। এই টার্গেট পুরণের মাধ্যমেই আসছে তার পরিবারের সচলতা। রাষ্ট্র খোদ নিজেই বদলে দিচ্ছে ন্যায়ের সংজ্ঞা। একথা সবাই জানেন রাষ্ট্রের মত একটা দমনপীড়নকারী প্রতিষ্টান তার ক্ষমতা ও তার বিকিরণের মাধ্যমে নিয়ত নতুন নতুন ন্যায়ের জন্ম দিয়ে থাকে। রাষ্ট্রের চরিত্র এক কথায় চমৎকার ব্যক্ত করেছিলেন ভ্লাদিমির লেলিন তার 'রাষ্ট্র' বক্তৃতায়। তিনি বলেছিলেন, রাষ্ট্র হচ্ছে এক শ্রেণি কর্তৃক অন্য শ্রেণিকে শোষণ করবার যন্ত্র মাত্র।

শোষক পুঁজিপতিদের রক্ষা ও বিদেশি শক্তির দাসত্ব ছাড়া তৃতীয় দুনিয়ার ক্ষমতাবানরা চলতে পারে না। জনগণ তাদের কাছে স্রেফ বাজার। তাদের মারো, বেচো, তাও সংবিধানসম্মত। সেই চির বঞ্চিত, লাঞ্চিত ও শোষিত জনগণেরই প্রতিনিধি আজ লিমন। ক্রসফায়ারে পরেও বেঁচে গিয়ে লিমন কাল হয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর। তার পায়ে গুলি করে তাকে পঙ্গু করা হয়েছে। তার কাছ থেকে অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে বলে তাকে অস্ত্র মামলায় ফাসানো হয়েছে। আবার মানুষকে বুঝানো হচ্ছে এই গাজাখুরি গল্প। অচেতন অবস্থায় তার চারদিকে ছড়ানো ছিটানো ছিল অনেক অস্ত্র ও বন্দুক। লিমন যদি অচেতনই ছিল তাহলে তার কাছ থেকে কিভাবে অস্ত্র উদ্ধার হলো, যদি ১৫ মিনিট ধরে ১৫ রাউন্ড ফায়ার হয় তাহলে সেই খোসা আর অস্ত্রগুলো কই?
লিমন যখন এদেশের আদলতে বারান্দায় কাঁদে, তার সাথে কাঁদে বাংলাদেশে আত্মা। কারণ লিমনই প্রকৃত ভূমিপুত্র। বিদেশি ট্রেনিংপ্রাপ্ত আইনের পোশাক পরা হত্যাকারীরা নয়।

ববিতা বড়ুয়াকে কি করে বাঁচাবো?


মেরুংলোয়া বড়ুয়াপাড়ার দিকে ঢুকবার আগে সীমা বৌদ্ধবিহারের গেইটে এসেই আমার মনে পড়লো ববিতার কথা, আকস্মিক। কারণ এই সেই গেইট আজ থেকে ১০ বছর আগে আমি এখানে খুঁজতে এসেছিলাম ববিতাদের বাড়ি। আর এখন খুঁজতে এসেছি অজস্র পোড়া বসতবাড়ি। গোলমাল হয়ে যাচ্ছিল বারবার। কিছুদিন ববিতা আমার খুবই কাছের বন্ধু হয়ে উঠেছিল। কারণ সে কবিতা ভালবাসতো। ভাল কবিতা আবৃত্তি করতো। অবশ্য ববিতার বাড়িতে আসার পেছনে ছিল সেই দুর্দমনীয় ধর্মীয় বিধিনিষেধ ভাঙার চেষ্টা। আমি প্রথম ববিতার কাছে শুকরের মাংস খেতে চেয়েছিলাম। কারণ এই জিনিস কেবল মাত্র বড়ুয়ারা খায় এইদিকে। প্রথমে গররাজি হলেও আমার অনমনীয়তার কাছে ববিতা হার মানে। একদিন ববিতা আমার কাঙ্খিত মাংস রান্না করে দাওয়াত করেছিল। এর আগে কোনোদিন আমি ববিতাদের বাড়ি যাই নাই। যদিও কক্সবাজারে সংস্কৃতিক রাজধানী রামুতে গেছি অনেকবার। সীমাবিহারের গেইট দিয়ে ঢুকেছিলাম ঠিকই কিন্তু ববিতার বাড়ি খুঁজে পাওয়া সম্ভব ছিল না। ববিতাই খুঁজে বের করেছিল আমাকে।  কিন্তু ববিতার বাবা আমতা বাধা দিয়েছিল কিন্তু ববিতা বলেছিল ‘জাহেদ্যা আধা বউরগ্যা’। আমার বৌদ্ধপ্রীতি সম্পর্কে ববিতা খানিকটা অবহিত ছিল।...


আজ এত বছর পর আমি আবার সীমাবিহারের গেইট দিয়ে ঢুকছি, এইবার আমার লক্ষ্যবস্তু মানে বড়ুয়াদের পুড়ে যাওয়া বসতবাড়ি খুঁজে পেতে আমার বেগ পেতে হয় নাই। কারণ তা দূর থেকেই দেখা যাচ্ছিল। সীমা বিহারের গেইট দিয়া ঢুকতেই নাকে এসে ধাক্বা মারে পোড়াগন্ধ। বৃষ্টির কারণে কালো হয়ে আছে রাস্তার কাদামাটি। ক্রমে আতংকিত বড়ুয়াদের অজস্র মুখ আমাকে অপরাধী করতে করতে পাশ কেটে যায়। এইটা মুসলমান হিসাবে নয় একজন মানবজাতির সদস্য হিসাবেই। 


প্রথম যে কয়টা ঘর আগুনে ভস্ম করা হয়েছিল। আগুনের তাপে ফেটে যাওয়া দেয়ালের প্লাস্টার। একসাথে উকি দেয়া বড়ুয়া মহিলাদের আতংকিত মুখ।যারা একমাত্র পরণের শাড়িটাই বাঁচাতে পেরেছিল।  সেগুলা খুঁজে পেতে আমার কষ্ট হয় নাই। এগুলা দেখতে দেখতে আমার মনে পড়ে যাচ্ছিল। এইখানকার এক মেয়ের সাথে আমার পরিচয় ছিল। মনে হচ্ছিল তাদের বাড়ি আরো ভেতরের দিকে। যাদের বাড়িতে আমি প্রথম শুকরের মাংস খেয়েছিলাম। ববিতার নামটা তখনো মনে পড়ছিল না। চেষ্টা করতেছিলাম কোন এক নায়িকার নামে নাম ছিল যেন মেয়েটার। কি নাম কি নাম। মেয়েটা রামু কলেজের কম্পিউটার ইন্সট্রাকটর। কি নাম কি নাম। এইটা ভাবতে ভাবতেই একটা পুড়ে যাওয়া দোকানের সামনে এসে পড়ি।


অমায়িক, অসহায় দোকানি বর্ণনা করছিলেন সেই বিভীষিকাময় রাতের। গল্পটা তিনিই প্রথম আমাকে বলেন যে, একবাড়িতে মুসলমানরা বাড়ির সকল সদস্যকে ভেতরে রেখে তালা মেরে আগুন লাগিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু তারা পেছন দিক দিয়া পালাতে সক্ষম হয়েছিল। বাড়ির কোনো জড়বস্তুই বাঁচতে পারে নাই। দুইটা ডেস্কটপ একটা লেপটপ। চারটা পড়ার টেবিল। দুইসেট সোফা। সত্তর হাজার টাকা। বাড়ির ছয় সদস্যের জামাকাপড় খাট বিছানা তোষক বালিশ কিছুই বাঁচতে পারে নাই। দোকানি আমাকে অনুরোধ করল আমি যেন তার সাথে ভেতরে গিয়া বাড়িটা দেখে আসি, বলল সে মিছা বলছে না। আমার চোখে কি তার কথা নিয়া সন্দেহ ছিল কোনো? হয়তো বা।


দোকানের পেছন দিয়া সে আমারে নিয়া যায় বাড়িটায়। ঢুকতেই এক বয়স্ক ফর্সা রাগান্বিত মুখ দেখতে পেলাম। সাদা লুঙ্গি আর সাদা পাঞ্চাবি পড়ে বয়স্ক মানুষটি ধ্বংশস্তুপের মধ্যে একটা প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে আছেন। এক দৃষ্টিতে  তাকিয়ে আছেন সামনে বৃষ্টির সাথে ভেসে যাওয়া কালো পানির দিকে। ঘরটার কালো দেয়াল ছাড়া অবশিষ্ট কিছু নাই। সকালে বিজিবি (বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ) এসে উপরে তাবু লাগিয়ে গেছে। ফাঁকফোকর দিয়ে বৃষ্টি পড়ছে।
হঠাৎ মানুষটা বলে উঠে নিজে নিজেই, যেন তিনি কাউকে উদ্দেশ্য করে বলছেন না এসব,
কোনো দিন তো বড়ুয়া মুসলমান আলাদা করে দেখি নি?
কেঁপে উঠি।
তিনি বলে উঠেন, আমার একমেয়ে রামু কলেজে চাকরি করে, আরেক মেয়ে বিসিকে, আরেক মেয়ে প্রাইমারি স্কুলে।
চমকে উঠি।
ততদিনে ববিতা কোথায় কাজ করতো সেসবও মনে নাই আর। হঠাৎ ভেতরের দিক থেকে ভেসে আসলো এক নারীকণ্ঠ, কে আসছে ওখানে বাবা..। 
দেখেই চিনতে পারলাম তাকে।
ববিতার বড়বোন। করবীদি আমাকে চিনতে পারেন নাই। বললেন আপনারা কোত্থেকে এসেছেন। রাগান্বিত করবীদির কণ্ঠস্বর। আমি বাকরুদ্ধ। আমি কোত্থেকে এসেছি? কোত্থেকে? কেন এসেছি এইখানে, নিজেও কি বুঝি? সেসব প্রশ্ন আমিও নিজেকে জিজ্ঞেস করছি। কেন, কেন, কেন?
করবীদি কিছু বলার আগেই তার বাবা মেলে দিলেন নিজের দুই হাত। যেখানে আগুনে পোড়া দুইটা দাগ দেখতে পাচ্ছি। আমি ভাবছি আর মনে মনে বলছি কবরীদি যেন আমাকে চিনতে না পারে। এখনো চিনতে পারে নাই। দশবছর আগে মাত্র একবার দেখা হয়েছিল তার সাথে, চেনার কথা না। যদিও আমার চোখ খুঁজে চলে ববিতাকে কিন্তু বাসনা করছি ববিতার সাথে যেন দেখা না হয়। দশবছর পর এরকম এক মুহুর্তে একদার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধুর মুখ দেখে সহ্য করতে অনেক শক্ত হতে হয় মানুষের মন। আমি কি অত শক্ত হতে পেরেছি?
নিজের অজান্তেই চলে যাই ভেতরের রুমে। যেখান থেকে পুরা পোড়াবাড়িটা দেখা যায়। পোড়া জানলা দিয়া তাকাতেই চোখে পড়লো এক তরুণীকে হয়তো সে গোসল সেরে ঢুকে যাচ্ছে রান্না ঘরের মতো নিচু একটা ঘরে। মাথায় ভেজা গামছা পেছানো মুখে রাজ্যের দুশ্চিন্তা। সত্যিকার অর্থে আমি তখনও চিনতে পারি নাই ববিতাকে।
হঠাৎ ফিরে জিজ্ঞেস করলাম মানুষটাকে, আপনার সেই মেয়েটা কোথায়, যিনি রামু কলেজে চাকরি করেন? 


ববিতা, ববিতা বলে হাক মারেন কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে তিনি। একটু পরেই রুমটায় এসে হাজির হলো ববিতা। ববিতার সেই দরাজ কণ্ঠ। রুমে ঢুকেই বলে কে কে আমাকে ডাকে? আমি মুখ লুকাতে পারলে বাঁচতাম। ববিতা আমার মুখের দিকে তাকায়। সে মুখ ফেরাতে পারে নাই। ফের তাকায়। কে তুই? চিৎকার করে উঠে সে মনোরোগীর মত। জা ... হে... দ্যা?


ববিতা চিনতে পারার পর ঘরের সবার চোখ আমার দিকে জড়ো হয়। চোখগুলা আমাকে শনাক্ত করার চেষ্টা করে। ববিতা বলে চলে, জাহেদ্যাকে চিনতে পারছেন না,আপনারা? সেই আধা বউরগ্যা। আমাদের বাড়িতে এসেছিল, শুকরের মাংস খাওয়ার জন্য।
করবীদি চিনতে পারে। মাসিমা চিনতে পারে। মাসিমার কান্নাসিক্তমুখটা আমার বুকে রেখে ফুফিয়ে উঠে। আমি ঘুরছি সব স্মৃতিফৃতিসহ, ঘুরছে আমার অস্তিত্ব।  ববিতা আমাকে হাত ধরে ভেতরের দিকে নিয়া চলে। নিতে নিতে দেখাতে থাকে আগুন কোথায় লাগানো হয়েছিল, কিভাবে বাড়ির টিনের চালে সে সবাইকে তুলে দিয়ে নিজেও লাফ দিয়ে বেঁচেছিল। কিভাবে পাথর এসে পড়ছিল তাদের মাথায় মুখে পিঠে। সে সব বলতে বলতে বাড়িটা প্রদক্ষিণ করলাম আমরা। এই কঠিন বাস্তবতা ভেদ করে দশবছর আগের স্মৃতি ডানা ঝাপটাচ্ছিল। কত বদলে গেছে ববিতা। এখন তাকে চেনাই যাচ্ছে না। হয়তো এতদিন বদলায় নাই, সেদিন রাত থেকেই... তার সদা হাসোজ্জল মুখটা পরিণত হয়েছে করুণ, মর্মান্তিক,আতংকিত, সন্দেহ পরায়ণতায়।  
আমাদের বাড়িতে কি কি ছিল তা তুই জানিস? আমি মাথা নাড়ছি হ্যা। সোফাগুলাতে তুই বসছিলি? হ্যা আমি মাথা নাড়ছি। মনে আছে সেই টেবিলটা? আমার আবৃত্তির ক্যাসেটগুলা? কত কবিতা? তুইযে একটা ক্যাসেট মেরে দিয়েছিলি মনে আছে? 
আমি দুনিয়ায় অনেকের কাছ থেকে কত বই, ক্যাসেট, টাকা নিয়া ফেরত দিই নাই তার কোনো হিসাব নাই। কিন্তু আজ খুবই অপরাধী মনে হচ্ছে নিজেকে। ববিতার ক্যাসেট টা কোথায় আছে খুঁজে দেখতে হবে। ফেরত দিতে হবে। কারণ তারতো এখন কোনো ক্যাসেট নাই। তার সব বইগুলা পুড়ে গেছে।


তুই কি কখনো মুসলমান ছিলি? আমি কি কখনো বড়ুয়া ছিলাম? আমরা তো মানুষ ছিলাম, বন্ধু ছিলাম। তার অবিশ্বস্ত চোখ সম্মতির জন্য আমার নতচোখের দিকে তাকায়। আমি এরকম লজ্জা কোনোদিন পাই নাই। পালিয়ে যেতে ইচ্ছা করছিল। এই মুসলমানিত্ব, হিন্দুত্ব, বড়ুয়াত্ব ছেড়ে, অন্য কোনো দুনিয়ায় যেখানে বন্ধুত্বই একমাত্র সহায় হয়ে দাঁড়ায়। সে ক্ষান্ত হয় না। সে আমাকেই যেন অপরাধী ভেবেছে, যেন তার সমস্ত অভিযোগ আমার বিরুদ্ধেই। 


আমাকে কিভাবে বাঁচাবি তুই, কিভাবে দাঁড় করাবি এই ভাঙ্গা ঘর? কিভাবে ফিরিয়ে নিয়ে আসবি সেই সম্প্রীতি? 


ভেবে চলেছি, ভেবে চলেছি আমি নিরন্তর এই পুঁজিবাদের সৃষ্ট আবর্জনার স্রোত সম্প্রদায়-অন্ধ জনগণের প্রতিনিধি হিসাবেই  'ববিতা বড়ুয়াদের কিভাবে বাঁচাবো আমরা ?'